মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৩

যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত মোবারক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ঢাকা: মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন বহিষ্কৃত আওয়ামী লীগ নেতা ও জামায়াতের সাবেক রোকন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোবারক হোসেন। হত্যা, আটক, নির্যাতন ও অপহরণের ৫টি অভিযোগ এনে মঙ্গলবার তার বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।

 
আগামী ১৬ মে মোবারকের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপনের দিন ধার্য করেছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল। এর আগেই রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের সাক্ষী তালিকা জমা দিতেও আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।

মোবারকের বিরুদ্ধে আনা ৫টি অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া থানার টানমান্দাইল ও জাঙ্গাইল গ্রামে ৩৩ জনকে হত্যা, আনন্দময়ী কালীবাড়ী রাজাকার ক্যাম্পে আশু রঞ্জন দেবকে নির্যাতন, ছাতিয়ানা গ্রামের আব্দুল খালেককে হত্যা, শ্যামপুর গ্রামের দু’জনকে অপহরণ করে একজনকে হত্যা এবং খরমপুর গ্রামের একজনকে আটক রেখে নির্যাতন। এসব অপরাধ ১৯৭১ সালের আগস্ট থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ে সংঘটিত হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।

অভিযোগ গঠনকালে মোবারক হোসেনকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তাকে অভিযোগগুলো পড়ে শোনানোর পর ট্রাইব্যুনাল জানতে চান, ‘‘এসব অভিযোগে আপনি দোষী না নির্দোষ?”। জবাবে মোবারক নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করেন। তার বিরুদ্ধে তার গ্রামের কেউ সাক্ষ্য দিতে এলে এবং তিনি দোষী সাব্যস্ত হলে আপিল করবেন না বলেও চ্যালেঞ্জ করেন মোবারক।

এর মধ্য দিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর ১০ম অভিযুক্ত হিসেবে বিচার শুরু হলো মোবারক হোসেনের। অন্য ৯ অভিযুক্তের মধ্যে ৩ জনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেছেন ট্রাইব্যুনাল, বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হয়ে রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ রয়েছে ২ জনের এবং বিচার চলমান রয়েছে বাকি ৪ জনের। 

এ পর্যন্ত দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও ২১ জানুয়ারি পলাতক জামায়াতের সাবেক রোকন (সদস্য) আবুল কালাম আজাদ বাচ্চু রাজাকারকে ফাঁসি এবং ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম ও অপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষ করে যে কোনো দিন রায় ঘোষণা করা হবে বলে অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়েছে যথাক্রমে গত ১৭ ও ১৬ এপ্রিল। অন্য ৪ অভিযুক্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরী এবং বিএনপির সাবেক নেতা সাবেক মন্ত্রী আব্দুল আলীমের মামলায় বর্তমানে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব চলছে।

গত ১০ এপ্রিল মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট সৈয়দ হায়দার আলী। তিনি মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে আনা ৫টি অভিযোগের বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা দেন। এসব অভিযোগের সাক্ষ্য-প্রমাণ তুলে ধরে তিনি অভিযোগ গঠনের আবেদন জানান ট্রাইব্যুনালের কাছে। ১১ এপ্রিল অভিযোগ গঠনের বিপক্ষে শুনানি করতে গিয়ে মোবারকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এ এইচ এম আহসানুল হক হেনা এসব অভিযোগকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও হয়রানিমূলক বলে দাবি করে তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দানের আবেদন জানান।

মোবারক হোসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার নয়াদিল গ্রামের সাদত আলীর ছেলে। তিনি স্বাধীনতার পর জামায়াতের ইউনিয়নের রোকন ছিলেন। পরে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হলেও দু’বছর আগে তাকে বহিষ্কার করা হয়।

২০১২ সালের ১৬ জুলাই থেকে ২০১৩ সালের ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত তদন্ত সংস্থার তদন্ত কর্মকর্তা শ্যামল চৌধুরী মোবারকের বিরুদ্ধে তদন্ত করেন। ৬ মাস ৭ দিন তদন্ত শেষে গত ২৪ জানুয়ারি মোট ৪ ভলিউমে ২৯৪ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে প্রসিকিউশনে দাখিল করে তদন্ত সংস্থা। এর ভিত্তিতে ২৫ ফেব্রুয়ারি মোবারকের বিরুদ্ধে ৩৩ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ(ফরমাল চার্জ) ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন প্রসিকিউশন। গত ১২ মার্চ এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ওই দিনই জামিনে থাকা মোবারকের জামিন বাতিল করে তাকে জেলহাজতে পাঠান ট্রাইব্যুনাল।

চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন ও আনুষ্ঠানিক অভিযোগেও মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, অপহরণের ৫টি অভিযোগ আনা হয়।

মোবারকের বিরুদ্ধে ২১ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালে সংঘটিত একটি হত্যার অভিযোগে মোবারকের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা ব্রাক্ষণবাড়িয়ার ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ওই মামলায় আটক হন মোবারক হোসেন।

মোবারকের বিরুদ্ধে ওই মামলায় অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেককে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়। পরের দিন গ্রামবাসী আব্দুল খালেকের লাশ পাশ্ববর্তী খাল থেকে উদ্ধার করেন। আরজিতে উল্লেখ করা হয়, যারা খালেককে ডেকে নেন তাদের মধ্যে আখাউড়া উপজেলার নয়াদিল গ্রামের মোবারক এবং জমশেদ মিয়া ছিলেন।

শহীদ আব্দুল খালেকের কন্যা খোদেজা বেগম ২০০৯ সালের ৩ মে ব্রাক্ষণবাড়িয়া চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি করেন। মোবারক হোসেন ওই বছরের ১৩ মে ওই মামলায় হাইকোর্ট থেকে ৬ মাসের আগাম জামিন নেন। এরপর কয়েক দফা জামিনের মেয়াদ বাড়ানো হয়। পরবর্তীতে আরেক দফা জামিনের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করলে হাইকোর্ট তাকে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেন।

পরে ২০১১ সালের ৯ অক্টোবর মোবারক হোসেন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করলে আদালত তার জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠান এবং মামলার নথিপত্র আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়ে দেন।

পরে গত বছরের ৬ জুন আসামিপক্ষের আইনজীবী ট্রাইব্যুনালে আপিল মোকদ্দমা করলে ট্রাইব্যুনাল এ মামলার নথিপত্র তলব করেন।

ট্রাইব্যুনালে মোবারকের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলাটি আসার পর মোট ৫ দফায় তাকে জামিন দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। তার জামিন আবেদনের প্রথম শুনানি হয় গত বছরের ১১ জুলাই। ওই দিন আসামিপক্ষ ও প্রসিকিউশনের শুনানি শেষে ১৬ জুলাই তাকে জামিন দেন ট্রাইব্যুনাল। এর পর ১৬ সেপ্টেম্বর জামিনের মেয়াদ দ্বিতীয় দফায় দুই মাস, ১৫ নভেম্বর তৃতীয় দফায় আরও দুই মাস বৃদ্ধি করেন ট্রাইব্যুনাল। ১২ ফেব্রুয়ারি ৪র্থ দফায় ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এবং ২৫ ফেব্রুয়ারি ৫ম দফায় ১১ মার্চ পর্যন্ত জামিনের মেয়াদ বাড়িয়ে দেন ট্রাইব্যুনাল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন