বৃহস্পতিবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৩

‘চোখের সামনে পুলিশ মরবে, মানতে পারিনি’

ইসমাইল হোসেন ও জনাব আলী
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
রাজশাহী থেকে: হরতালের মধ্যে খুঁজতে বের হয়েছিলেন বুকের ধন, ছোট ছেলেকে। আকস্মিক ককটেল-বোমার শব্দে প্রকম্পিত চারদিক। জনশূন্য পিচঢালা রাজপথে রক্তাক্ত দেহ। তখনও রক্তক্ষরণ হচ্ছিল মাথা থেকে। সন্তানের কথা ভুলে রক্তাক্ত পুলিশ সদস্যকে উদ্ধারে এগিয়ে আসেন ঝর্ণা। বেঁচে যায় একটি জীবন।
চারদিন আগে রাজশাহী মহানগরীর শালবাগান এলাকায় জামায়াত-শিবিরের বর্বরতার শিকার পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) জাহাঙ্গীর হোসেনকে মৃত্যুর মুখ থেকে উদ্ধারে প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন ঝর্ণা বেগম। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার বদৌলতে জামায়াত-শিবিরের বর্বরতার বিপরীতে মমতাময়ী মা কিংবা বোনের চরিত্র দেখতে পেয়েছে জাতি, বিশ্ব।

ঝর্ণা বেগম এখন একটি পরিচিত মুখ, তার মমতার কাছে হার মেনেছে জামায়াত-শিবিরের পৈশাচিকতা। রাজশাহীর ভাড়া বাসায় বাংলানিউজের কাছে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে উদ্ধারের দৃশ্যপট বর্ণনা করছিলেন, ব্যক্ত করছিলেন তাঁর অভিব্যক্তি।

ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে ঝর্ণা বেগম বলেন, “সকাল সাড়ে ১০টা। হঠাৎ গুলি-বোমা-ককটেল-গুলির শব্দে ব্যস্ত রাস্তায় আতঙ্কিত মানুষ। প্রাণ বাঁচাতে যে যার মতো দৌড়ে চলে যায় নিরাপদে। শুরু হয় শিবিরের তাণ্ডব। জনমানবশূন্য এলাকায় পুলিশের একটি টহল দল ঘটনাস্থলে আসে। কিন্তু তাণ্ডবকারীদের চেয়ে সংখ্যায় কম হওয়ায় বিপদ বুঝে তারাও সটকে পড়ার চেষ্টা করে। সুযোগ বুঝে দলে থাকা পুলিশ অফিসারকে ধরে ফেলে শিবির কর্মীরা।”

কথা বলতে বলতে শিউরে উঠে চোখ ছলছল করে উঠছিল ঝর্ণার। হাতের তালুতে চোখ মুছতে মুছতে বলেন, “এরপর শুরু হয় তাঁর ওপর পৈশাচিক-নারকীয় নির্যাতন।”

“সঙ্গে থাকা এক পুলিশ কনস্টেবল আক্রান্ত ওই পুলিশকে বাঁচাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু হামলাকারীদের উন্মত্ত আচরণের মুখে দৌড়ে প্রাণরক্ষা করতে বাধ্য হন তিনি। এ সময় শিবির কর্মীরা জাহাঙ্গীরকে তারই হেলমেট আর ইট দিয়ে অমানুষিকভাবে পেটাতে থাকে। থেঁতলে যায় তার মাথা। আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করে পুরো শরীর। এক পর্যায়ে কোমরের বেল্টে থাকা পিস্তলটিও ছিনিয়ে নিয়ে যায়। দূরে দাঁড়িয়ে এ হামলা প্রত্যক্ষ করেন অনেকে, কিন্তু এগিয়ে আসেননি কেউই।”

ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে উদ্ধারে কেউ এগিয়ে না এলেও এগিয়ে আসেন এই সাহসী নারী ঝর্ণা। নিজের জীবনের মায়া ছেড়ে এসআই জাহাঙ্গীরকে রাস্তা থেকে তুলে হাসপাতালে নেওয়ার উদ্যোগ নেন তিনি। তার দেখাদেখি এগিয়ে আসেন আরও দুই সাংবাদিক। ধরাধরি করে নিয়ে যান হাসপাতালে।

ঝর্ণা বলেন, “তাকে উদ্ধার করে ইজিবাইকে করে নিয়ে যাই হাসপাতালে। ইজিবাইকে ওঠানোর সময় এসআই জাহাঙ্গীরের মাথা থেকে রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে ওড়নার আঁচল দিয়ে বেঁধে মুছিয়ে দিতে থাকি।”

এসআই জাহাঙ্গীরের ওপর পৈশাচিক আক্রমণ ও তাকে উদ্ধারের এমন দৃশ্য লাইভ টেলিকাস্ট করে অনেক টেলিভিশন চ্যানেল। ঝর্ণা এসআই জাহাঙ্গীরের সহোদরা বা পিতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন সে সময়। সবাই মিলে মুমূর্ষু জাহাঙ্গীরকে নিয়ে যান হাসপাতালে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি ২/৩ ঘণ্টা পাশে থাকেন ওই পুলিশ কর্মকর্তার।

ঝর্ণা কাজ করেন রাজশাহী মহানগরীর আরডিএ মার্কেটের একটি বিউটি পার্লারে। পারিবারিক জীবনে ছেলে নীরব (১২) ও মেয়ে সানজিদার (৫) জননী। স্বামী শাহীন ঢাকার মিরপুরে একটি সিল্কের কারখানায় ব্লক মাস্টার। তবে পাঁচ বছর ধরে স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ নেই তার। লোকমুখে শুনেছেন, সেখানে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন শাহীন। অভাব-অনটনের সংসারে বিউটি পার্লারে কাজ করে সংসার চালান। শালবাগান এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন দু’সন্তান নিয়ে।

জামায়াত-শিবিরের নগ্ন সহিংসতার মুখে প্রশিক্ষিত ও সশস্ত্র পুলিশ সদস্যরা যখন সহযোদ্ধাকে মৃত্যুর মুখে ফেলে পালান, তখন দুঃসাহসী উদ্ধার কাজের নেতৃত্বে এগিয়ে আসেন ঝর্ণা বেগম। সেই এসআই জাহাঙ্গীর এখন রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক (সিএমএইচ) হাসপাতালে।

একজন দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তার জীবন রক্ষায় বিশেষ সাহসিকতার ভূমিকা পালনের জন্য রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের ১৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের পক্ষ থেকে ঝর্ণাকে সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। বুধবার স্থানীয় কাউন্সিলর অফিসে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে তাকে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন কাউন্সিলর আব্দুস সোবহান।

রাজশাহীতে শিবিরের বোমায় এক পুলিশের দু’হাতের কব্জি উড়ে যাওয়া এবং এসআই জাহাঙ্গীরের ওপর নারকীয় হামলার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর রাজশাহী থেকে মৌলবাদ মুক্ত করার জন্য নির্দেশ দেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে। বুধবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজশাহীর সাহসী এই নারীকে যথাযথ স্বীকৃতি ও পুরস্কৃত করা হবে বলে জানান।

ওই দিন জীবনের ঝুঁকি নিয়েও এসআই জাহাঙ্গীরকে উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে ঝর্ণা বলেন, “সবার আগে আমার পরিচয় আমি একজন মানুষ। জন্ম যখন হয়েছে, মৃত্যু একদিন হবেই। একজন মানুষ হয়ে আমার চোখের সামনে আরেকজন মানুষ মারা যাবে, এটা আমি মেনে নিতে পারিনি। তাই জীবন দিয়ে হলেও একজন মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছি। এটা আমার দায়িত্ব, কর্তব্য। এটিই মানবতার ধর্ম।”

সাহসী এই নারীর ভূমিকা প্রসঙ্গে রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার মনির-উজ-জামান বাংলানিউজকে বলেন, “একজন পুরুষ যা করতে পারেনি, ঝর্ণা তা করেছে। নারী হয়েও আমাদের পুলিশ কর্মকর্তাকে উদ্ধারে এগিয়ে এসে পুরো পুলিশ পরিবারকে দায়বদ্ধ করে ফেলেছে।”

তিনি আরও বলেন, “তিনি মমত্ববোধ ও দেশত্ববোধের জায়গা থেকে যে অসীম সাহসের সঙ্গে এগিয়ে এসেছেন, সেজন্য ব্যক্তিগতভাবে তাকে স্যালুট জানাই।”

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর ঘোষণার কথা তুলে ধরে মনির-উজ-জামান বলেন, “বৃহস্পতিবার তাকে বিশেষ সম্মাননা জানানো হবে, আমরা তার পাশে থাকবো সব সময়।”

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন