মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০১৩

বিএনপিও সংসদে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছিল

মুনতাসীর মামুন
১৯৯৩ সালে খালেদা জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী তখন জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালায়। এই হামলায় এক বিএনপি নেত্রীর পুত্র রিমু মারা যান। তখন শুধু আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপির সংসদ সদস্যরা সংসদে জামায়াত নিষিদ্ধের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। ঐ দিন যাঁরা সোচ্চার ছিলেন জামায়াতের বিরুদ্ধে আজ তাঁরা যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের পক্ষে। এই হচ্ছে বিএনপি এবং যারা বিএনপি করে তাদের মৌল চরিত্র। পাঠকদের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য সেই সময় সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন সংকলন করা হলো]:
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুমন্ত ছাত্রদের ওপর জামায়াত-শিবিরের নৃশংস হামলা ও একজনকে খুন করার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সোমবার সংসদের পূর্ব নির্ধারিত দিনের কার্যসূচী মুলতবি করে বিষয়টির ওপর ৪ ঘণ্টা আলোচনা হয়েছে। সরকারী ও বিরোধী দলের ৩৩ জন সদস্য এতে অংশ নেন এবং প্রায় সবাই ওই ঘটনায় তাঁদের ঘৃণা প্রকাশ করে দেশে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি জানান। সরকারী দলের একজন সদস্য এ ব্যাপারে বিল আনার আহ্বান জানিয়ে বলেন, প্রয়োজনে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে তিনি ওই বিলে ভোট দেবেন। সরকারী দলের পক্ষে সমাপনী বক্তৃতায় সংসদ উপনেতা অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি বন্ধের ব্যাপারে বলেন, [এক্ষেত্রে সংবিধান কি বলে তা দেখতে হবে; তবে তিনি স্পষ্টভাবে বলেন] রগ কাটা ও জবাই করার রাজনীতি চলতে দেয়া যায় না। আলোচনার মাঝামাঝি সময়ে রাত সোয়া ১০টায় সামান্য হৈচৈ করে জামায়াতের এমপি’রা ওয়াক আউট করেন। তার আগ পর্যন্ত তাঁরা মুখ কালো করে বসেছিলেন। ওয়াক আউট করার সময় তাঁদের একজন এমপি ‘পরে মজা টের পাবেন’ এ হুমকি দিয়ে গেছেন বলে আওয়ামী লীগের আবদুল আওয়াল মিয়া সংসদে অভিযোগ করেন।

সংসদ মুলতবি করে বিষয়টির ওপর আলোচনার জন্য ৩৩ জন বিরোধীদলীয় সদস্য নোটিস দিয়েছিলেন। আলোচনা শুরুর আগে সংসদ উপনেতা বলেন, সরকারী দলের সদস্যরাও বক্তব্য রাখতে চান। স্পীকার ৬২ বিধিতে আওয়ামী লীগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের মুলতবি প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং বিএনপি সদস্যরা যাতে আলোচনায় অংশ নিতে পারেন সেজন্য অন্য সকল বিধি স্থগিত রাখেন। বর্তমান সংসদে বিরোধী দলের মুলতবি প্রস্তাবের ওপর উভয়পক্ষের আলোচনা এই প্রথম। জামাযাত বাদে অন্যান্য দলের সদস্যদের একই ধারার বক্তব্য দেয়ার এই ঘটনা একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনী বিল পাসের পর আর ঘটেনি। সংসদ নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এ আলোচনার সময় অনুপস্থিত ছিলেন।

সংসদ উপনেতা অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী সমাপনী বক্তৃতায় বলেছেন, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব সংবিধানের মাধ্যমে পরীক্ষা করার অবকাশ রয়েছে। জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে সংসদ যে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার দৃঢ়ভাবে সে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। সংসদ উপনেতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, আপনাকে ক্ষমাহীন পদক্ষেপ নিতে হবে। যারা মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। সীমা লঙ্ঘন করেছে তাদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়াও এদের পেছনে যারা রয়েছে তাদের মুখোশ খুলে দিতে হবে। তিনি শিক্ষামন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উভয়ের উদ্দেশে বলেন, শিক্ষাঙ্গনগুলোকে সন্ত্রাসমুক্ত করার জন্য যেকোন কঠোরতম পদক্ষেপ নেয়া হলে সংসদ আপনাদের পক্ষে থাকবে। আমরা এই সংসদ সদস্যরা আমাদের সন্তানদের হত্যার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। এর পরে যেন আর কোন মায়ের বুক খালি না হয় এ ধরনের কোন ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ। আমরা ধর্মকে বিকৃত করে ফায়দা লোটার যেকোন অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধেও ঐক্যবদ্ধ। তিনি বলেন, সকলের সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে রাজনীতি করার। কিন্তু সংবিধান হত্যা বা সন্ত্রাসের অধিকার দেয়নি। দেয়নি গণতন্ত্র বিপন্ন করার অধিকার। যারা ধর্মকে ব্যবহার করে, ধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করে ঘুমন্ত ছাত্রদের হত্যা করে তাদের বিরুদ্ধে এই সংসদ তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করছে। এ ধরনের ঘটনা বর্বর ও পৈশাচিক।

তিনি বলেন, যে রাজনীতি হত্যার, রগ কাটার, হাত কাটার, জবাই করার সেটা কি ধরনের রাজনীতি। এটা স্বাধীন দেশের রাজনীতি হতে পারে না। সিদ্ধান্ত নিতে হবে এ রাজনীতি চলতে দেয়া যায় কিনা। তিনি বলেন, এটা অত্যন্ত সত্য কথা যে, এটা অসুস্থ ও বিকৃত রাজনীতি। মানসিক বিকৃতরা ছাড়া হত্যার রাজনীতি কেউ করতে পারে না। যারা হত্যা করে উল্লসিত হয় তারা স্বাভাবিক মানুষ নয়, সাইকোপ্যাথ। এই অস্বাভাবিক মানুষরা ভোটার হতে পারে না। যারা ভোটার হতে পারে না তারা রাজনীতি করবে কি করে? তোফায়েল আহমেদ বলেন, শিক্ষা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বপদে থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলও তা চেয়েছে।

বিএনপি’র যেসব এমপি মামুলি কথা বলেছেন তাঁদের উদ্দেশে তোফায়েল বলেন, নিজের দলের মধ্যে স্বাধীনতা বিরোধী যারা আছে তাদেরকে পদত্যাগে বাধ্য করুন। ১২ অনুচ্ছেদ (ধর্ম নিয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধ) সংবিধানে পুনর্বহাল করতেও তিনি তাদের সাহায্য কামনা করেন।

আওয়ামী লীগের আবদুর রাজ্জাক বলেন, আজকের দিনটি ঐতিহাসিক। কারণ সরকারী দলও উপলব্ধি করছে অশুভ জামাযাত-শিবির টিকে থাকলে দেশ ধ্বংস হবে। তিনি বলেন, সংসদে যে ৪ দফা চুক্তি হয়েছিল তা বাস্তবায়িত হলে আজকের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না।

শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ করেন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তার পদত্যাগের যে দাবি করা হয়েছে তিনি তার বিরোধিতা করে তার আমলে শিক্ষা ব্যবস্থায় কি কি উন্নতি হয়েছে তার বর্ণনা দেন। স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে খ্যাত অধ্যাপক আবদুল বারী প্রসঙ্গে একটি অভিযোগের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, তিনি রাজাকার নন। তিনি খুবই মেধাসম্পন্ন লোক। শিক্ষামন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় একেবারে জামায়াত-শিবিরের কথা বলেননি।

বিরোধী দলের চীফ হুইপ মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ঘাতকদের কোন ধর্ম নেই, নীতি নেই, আসুন ওদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হই। তিনি বলেন, মতিন নামের মানুষগুলো বিএনপি’র রাজনীতিতে কোনদিন বিশ্বস্ত ছিলেন না। আজকের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মতিনের নির্লিপ্ততায় তার নিজের দলের ছেলেরা খুন হচ্ছে। এ ঘটনায় শুধু নিন্দা নয়, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। এ অধিবেশনে সম্ভব না হলে আগামী অধিবেশনে এ ব্যাপারে বিল আনতে তিনি সরকারী দলের প্রতি আহ্বান জানান। আপনাদের প্রয়াত নেতা আপোস করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন। এ কথা উল্লেখ করে বিএনপি’র উদ্দেশে তিনি আপোসের পথ পরিহার করার আহ্বান জানান। তিনি ব্যর্থ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বরখাস্ত করার দাবিও জানান।

বিএনপি’র হুইপ অধ্যাপক শাজাহান বলেন, জামায়াত-শিবির সীমা লঙ্ঘন করেছে। তিনি নিজের এলাকার কথা উল্লেখ করে বলেন, ধর্মের নামে এমন কিছু নেই যে ওরা করতে পারে না। রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে জামায়াত-শিবিরের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘৭১-এ ওরা যেভাবে আমাদের মা-বোনদের ধর্ষণ করেছে, সেইভাবে তারা আজ ধর্মকে ধর্ষণ করছে। ইসলাম ধর্মকে তিনি জামাতের হাত থেকে রক্ষা করার আবেদন জানান। তিনি বলেন, বিএনপি’র বন্ধুরা আজ মনের কথা বলেছেন। প্রস্তাব নিয়ে আসুন, ওদের নিষিদ্ধ করুন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীকে বলতে হবে কি ব্যবস্থা নিয়েছেন ঐ মৌলবাদী ধর্মাশ্রয়ীদের বিরুদ্ধে।

বিএনপি’র শাহাজান ওমর বলেন, একটি স্বাধীন দেশের সংসদে প্রতিদিনই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসী ঘটনা নিয়ে আলোচনা করতে হয়, এটা লজ্জাজনক। জামায়াত নেতা মাওলানা নিজামীর উদ্দেশে তিনি বলেন, দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দেবেন না, কিভাবে রাজাকার নিধন করতে হয় আমরা জানি। এই সংসদেও কোন প্রেতাত্মা থাকলে তাও ধ্বংস করতে জানি। নিজের দলসহ বিভিন্ন দলের এমপিদের উদ্দেশে তিনি বলেন, জামায়াতকে কেন আপনারা এসব কাজ করতে দেন? আলোচনার সময় সংসদে শিক্ষামন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, তাহলে এ আলোচনার অর্থ কি?

বিএনপি’র হুইপ আশরাফ হোসেন বলেন, লেখাপড়া করতে গিয়ে ছাত্ররা লাশ হয়ে বাড়ি ফিরবে এ অবস্থা দুঃখজনক। শিবির বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেসব সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করছে তিনি তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান।

জাতীয় পার্টির আবু লেইস মবিন চৌধুরী বলেন, আজ নিজের ঘরে আগুন লেগেছে বলে বিএনপি এখন জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে বলছে। এতদিন মুখ বন্ধ করে ছিল।

শাজাহান সিরাজ বলেন, গোলাম আযমের বংশধররা কি করতে পারে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। বিএনপি গোলাম আযমকে দুধ-কলা দিয়ে পুষছে। কি হবে তাও টের পাচ্ছেন বিএনপি’র বন্ধুরা। জামায়াত-শিবিররা বিশ্ববিদ্যালয়কে দুর্গ করে গড়ে তুলছে। পুলিশ কি করে? আজ সিদ্ধান্ত নিতে হবেÑ হয় স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বাংলাদেশে বেঁচে থাকবে, না হয় ওরা থাকবে। আমরা যদি আমাদের সন্তানদের সত্যিই ভালবাসি তাহলে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করতে হবে। সারা জাতি আমাদের দিকে চেয়ে আছে কবে আমরা রগ কাটার রাজনীতি বন্ধ করব।

তিনি বলেন, রাজশাহী ছাত্রদলসহ সকল রাজনৈতিক দল এক হয়েছে। এই ঐক্যের মতো আসুন আজ সংসদের সকল দল মিলে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব নিই।

আওয়ামী লীগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, যে মুহূর্তে আজানের ধ্বনি সে মুহূর্তে জামায়াত-শিবির যারা ধর্মান্ধ রাজনীতি করে তারা হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। জুবায়েরকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। ৬টি হলে একযোগে হামলা চালানো হয়। ’৭১ সাল থেকে তারা শুরু করে এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা। আজও তারা সেটা চালিয়ে যাচ্ছে। এদেশকে মেধাশূন্য করার জন্যই এটা করা হচ্ছে সুপরিকল্পিতভাবে।....

বিরোধী দলের ভারপ্রাপ্ত নেতা আবদুস সামাদ আজাদ বলেন, শিক্ষামন্ত্রী জামায়াত-শিবিরের নাম উচ্চারণই করলেন না, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর [মুখ থেকে শব্দ দুটো বের করতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। তাদের শক্তির উৎস কোথায় সবাই জানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর] বিরুদ্ধে কথা বলায় উনি হুমকি দিয়েছেন পরে জবাব দেবেন। আমরাও ওনার জবাবের প্রতীক্ষায় থাকলাম। রাজশাহী ছাত্রদলের ২ হাজার নেতা-কর্মীর পদত্যাগের খবর সরকার সমর্থক পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তা অস্বীকার করায় সামাদ আজাদ [নিজে পদত্যাগ করেননি বলে কি পদত্যাগ করার মতো বিবেকবান মানুষের অভাব আছে?] বলেন, আমরা পুলিশের বিরোধিতা করি না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশকে দিয়ে উল্টোপাল্টা কাজ করাচ্ছেন। অধ্যাপক বারীর মতো রাজাকারের সাফাই গেয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী, এতে আমরা অবাক হইনি- একথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২/৪ জন জমিরউদ্দিন সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দেশবাসীকে সরাতে পারবেন না। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ঘটনার জন্য দায়ী জামায়াত-শিবির এবং ব্যর্থ প্রশাসনিক কর্মচারীদের শাস্তি, তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা এবং সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদের পুনরুজ্জীবন দাবি করেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মতিন চৌধুরী বলেন, গত দু’দিনে যেসব ঘটনা ঘটেছে তার নায়করা গণতন্ত্র ও মানবতার শক্র (বিরোধী দলের এমপিরা জিজ্ঞেস করেন, তারা কারা? এই পর্যায়ে জামায়াত-শিবিরের নাম উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন) যারা এ ঘটনার সাথে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে। জামায়াত নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের কর্মীরা গ্রেফতার হলে তদবির করবেন না তাদের ছাড়ানোর জন্য। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যেসব কথা বলা হয়েছে সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে এখন কিছু বলব না। (ভবিষ্যতে জবাব দেব)। বিরোধী দলের একজন এমপি মন্তব্য করেন, (সে জবাব কি লাঠিচার্জ)? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ হাজার ছাত্রদল নেতা-কর্মী পদত্যাগ করেছেন। এ কথা ঠিক নয় বলে তিনি দাবি করেন। [ কিন্তু ঘটনা ঘটলেই সরকার ব্যর্থ-বিরোধী দলের এ কথাও ঠিক নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।] সন্ত্রাস বন্ধে তিনি সকল দলের সহযোগিতা কামনা করে বলেন, এ দায়িত্ব তার একার নয়। রাজশাহীর ঘটনায় পুলিশ নীরব ছিল একথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, জামায়াত-শিবিরের ২৪ জনকে এবং খুলনার ঘটনায় ৩৯ জনকে গ্রফতার করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের তোফায়েল আহমেদ অভিযোগ করেন, শিক্ষামন্ত্রী জামায়াত-শিবিরের নাম একবারেও উচ্চারণ না করে হাস্যরসের মাধ্যমে পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করেছেন। এতেই প্রমাণিত হয় স্বাধীনতাবিরোধীরা যখন যে অবস্থানেই থাকেন না কেন শেকড়ের কথা ভুলতে পারেন না।

শওকত আলী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সমালোচনা করে বলেন, তিনি সংসদের সকলের ঐকমত্যের ব্যাপারটি এড়িয়ে ভিন্ন সুরে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, জামায়াত পশু ও হিংস্র। কারণ তারা মানুষ হত্যা করে আনন্দ-উল্লাস করে। তারা ধর্মের আবরণে নিজেদের কুৎসিত চেহারা ঢেকে রাখে। কিন্তু তাদের কুৎসিত চেহারা বার বার প্রকাশ পেয়েছে। অথচ সরকার তা আড়াল করে প্রশ্রয় দিয়েছে। আজ স্বাগতঃ জানাই সকলেই জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের জন্য ঐকমত্য পোষণ করেছেন। আশা করি সরকার এই মতের সঙ্গে এক হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।

গণতন্ত্রী পার্টির সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, যেদিন জামাতের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করা হয় সেদিনই মনে হয়েছিল দুর্ভোগ আছে। বিএনপি’র [ভুলের মাসুল আজ জাতিকে দিতে হচ্ছে। এই ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তির সহায়তা নেয়ার জন্য যে দু’জন বিএনপি] নেতা তোজজোড় করেছেন তার একজন সংসদে উপস্থিত আছেন। তিনি হচ্ছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বিকৃত রাজনীতির ধারকরাও শুধু রাজশাহী নয়, আরো অনেক স্থান দখল নেয়ার পাঁয়তারা করছেন।

তিনি বলেন, রাজশাহীতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগসহ যে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ সংসদে তাই প্রতিফলিত হয়েছে।

তিনি বলেন, স্বাধীনতা শক্তি ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এক হতে পারে না। যেমন তেল আর জল মিলতে পারে না। বিএনপি ঐ বিকৃত রাজনীতির ধারক গণতন্ত্রের শত্রুর পক্ষে থাকতে পারে না। ভারতের মত ‘ধর্ম নিয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধ’ করার বিল সংসদে আনার জন্য সরকারী দলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এ বিল আমরা পাস করে দেব।

আওয়ামী লীগের বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, যে ছাত্রদলকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী গর্ববোধ করেন সে ছাত্রদলের সদস্যদের হত্যা, রগকাটা হলেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। এর কারণ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে এক সময় জামায়াতের সম্পর্ক ছিল। তিনি বলেন, জামায়াত-শিবির ধর্মান্ধ ও ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি করছে ’৭৮ সাল থেকে। মানুষ অপরাধ করে লজ্জা পায়, জামায়াত-শিবির অপরাধ করে আনন্দ পায়। এরা হত্যা করে উল্লাস করে। এখন প্রশ্ন এসে দাঁড়িয়েছে বিবেচনা করার-মানবতার পক্ষে থাকব না পশুত্বকে প্রশ্রয় দেব। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রস্তাব নিতে হবে এদের বিরুদ্ধে। ৪ দফা চুক্তি বাস্তবায়ন করে গোলাম আযমের বিচার করতে হবে।

ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন বলেন, খুনীদের এ দেশে ক্ষমা করা যাবে না, এটা আজ সমস্বরে সকল সদস্য বলেছেন। তিনি বলেন, সরকারের মধ্যে ওদের বন্ধু আছে। রাজশাহীর ভিসি নামে, জিয়া পরিষদ বেনামে জামায়াতে ইসলামী। পুলিশকে শিবিরের পক্ষে নামানো হয় সে প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। তিনি বলেন, প্রক্টর-প্রোভিসি জামায়াতের কর্মী। ... ঘুমন্ত ছাত্রদের ওপর এই নির্মম আক্রমণ প্রতিহত করার ব্যর্থতার জন্য শিক্ষামন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত। এরা আমাদের সন্তানদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারছেন না।

বিএনপি’র আবদুল আলী মৃধা বলেন, এটা কলঙ্কজনক ঘটনা। এরা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। এরা রগকাটা ও গলাকাটার দল। এরা ‘জামায়াত-শিবির’। তারা আমাদের সন্তানদের লেখাপড়া করতে দিচ্ছে না। এরা পাক বাহিনীর মতো। জামায়াত-শিবির চাচ্ছে বাংলাদেশকে শেষ করে দিতে। জাতির চাহিদা স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। এই রাজাকার ও আলবদররা তাদের সন্তানদের দিয়ে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের হত্যা করছে। এই জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা ও সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এদের বিরুদ্ধে ’৭১ সালের মতো কবর রচনা করতে হবে। যারা আমাদের সন্তানদের হত্যা করছে তারা মানুষ নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেন, পুলিশ কেন নিষ্ক্রিয় ছিল। পুলিশকে ওদের দোসর হিসেবে চিহ্নিত করে বিচার করতে হবে। শোককে শক্তিতে পরিণত করে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নিতে হবে যাতে জামায়াত-শিবির দেশে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।
আওয়ামী লীগের তাজুল ইসলাম ফারুক বলেন, জামায়াত-শিবির যখন নারকীয় আক্রমণ চালায় তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল। তারা সহায়তা করেছে শিবিরকে। কারা নিয়ন্ত্রণ করছে পুলিশ? সরকার না শিবির?
তিনি বলেন, পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা রাজশাহীর কৃতী ছাত্রদের হত্যা করছে। জাতির স্বার্থে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হোক।

বিএনপি’র মেজর (অব.) হাফিজ বলেন, আজ জাতি চায় জামায়াাত-শিবিরের বিচার। ’৭১-এর হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে এদেশবাসীকে হত্যা করেছে। তারা পাকিস্তানের রাজনীতি করে। এই রাজনৈতিক দলটি চিরকাল গণবিরোধী রাজনীতি করেছে। দিনের পর দিন তারা ছাত্রদের হত্যা করেছে। আজ তাদের বিচার চাই। আমরা এই অশুভ শক্তির তা-ব বন্ধ চাই। ’৭২ সালে স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমার ফল এটা। এটাই জাতির জন্য কাল হয়েছে। যারা আজ ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে সেই জামায়াত-শিবিরের ধর্ম নিয়ে রাজনীতি চিরতরে নিষিদ্ধ করতে হবে। ধর্ম ব্যবসায়ী রাজনীতির ধারক জামায়াত-শিবিরের উৎখাত চাই।

আওয়ামী লীগের শামসুল হক বলেন, স্বরাষ্ট্র ও শিক্ষামন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করতে চাই কি জবাব দেবেন ঐ ছাত্রের পিতা-মাতাকে।

তিনি বলেন, আর যদি আমার কোন ভাই বা ছেলেকে হত্যা করা বা রগ কাটা হয় আমরাও ওদের সংসদ থেকে বের করে দেব। জাতির আশা অনুযায়ী জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করতে হবে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের সন্ত্রাসের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপি’র দু’জন সদস্য বিরোধী দলের প্রতি জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি বিল আনার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, প্রয়োজনে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে হলেও তাঁরা ঐ বিলের পক্ষে ভোট দেবেন। এ দু’জন হচ্ছেন মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান ও সিরাজুল ইসলাম সরদার। দু’জনেই তাঁদের বক্তব্যের সময় বিরোধী দল ছাড়াও নিজ দলের অনেক সদস্যের টেবিল চাপড়ানোর সমর্থন পান। বক্তব্য শেষের পর অনেক সদস্য উঠে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে করমর্দন করেন।

মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান বলেন, দুর্ভাগ্য আমাদের স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করতে হয়। ক্ষমতার এমনই নেশা।

তিনি বলেন, দুঃখ ও দুর্ভাগ্য আমার স্পীকার, আপনার কাছ থেকে সময় ভিক্ষা করে কথা বলতে হয়। ’৭১ সালে যদি আপনার সঙ্গে দেখা হতো তবে আপনি কোথায় থাকতেন আর আমি কোথায়, জানি না।
তিনি বলেন, একটি স্বাধীন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়া উচিত ছিল একজন মুক্তিযোদ্ধার। তা হয়নি। তিনি বলেন, দোষ দেয়া হয় পুলিশের, পুলিশের দোষ নেই। ওদের ওপর বসিয়ে দেয়া হয়েছে স্বাধীনতাবিরোধীদের। তিনি জামায়াত-শিবিরকে সামাজিকভাবে বয়কট করার জন্য আবেদন জানিয়ে বলেন, এখন থেকে প্রতিজ্ঞা ও সিদ্ধান্ত নিতে হবে, ওদের সঙ্গে কোন সমঝোতা নেই।
জনকণ্ঠ, মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০১৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন