বৃহস্পতিবার, ২১ মার্চ, ২০১৩

কারো ভয় এবং কারো জয় : অভিন্ন লক্ষ্য এযাবৎ

পত্রিকায় লাল হরফের শিরোনাম :‘শহীদ মিনার পুড়লো’। উপ-শিরোনাম হচ্ছে, ককটেল মেরেছে মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় কালীমন্দিরে আগুন ইট ছুড়ে হত্যা করেছে ট্রাকচালককে গণজাগরণ মঞ্চ পুড়িয়ে দিয়েছে”। পাশেই দু’টি ছবি, একটিতে বিশাল বাঁশ হাতে ‘রূপগঞ্জের ভুলতায় ছাত্রদল কর্মীদের নির্বিচারে গাড়ি ভাঙচুর’ আর দ্বিতীয়টিতে ‘হরতাল চলাকালে ফার্মগেটে স্বাভাবিক যানচলাচল’। ওই যে ছবির কিশোর-যুবকরা বাঁশ-হাতে গাড়ি ভাঙচুর করছে, ওদেরকে ‘নিয়োগ বা বিনিয়োগ’ করেছেন স্থানীয় বড় কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা, ওরা যদি সফল হয়, ‘আন্দোলন’ যদি সফল হয়, ‘সেই নেতা’ আরো বড় নেতা হবার সুযোগ পাবেন, হতে পারেন এমপি-মন্ত্রীও। কিন্তু বাঁশ-হাতে তরুণদের ভবিষ্যৎ কী? বর্তমানটাই বা কী দাঁড়াবে যদি পুলিশ গ্রেপ্তার করে, গুলি চালায়? হয়তো ওদের পিতামাতা ভাবছেন, সন্তানরা ‘রাজনীতি’ করছে। রাজনৈতিক নেতা-মস্তানের পথটা একপথ নয় কিছুতেই। কিন্তু ওদের পিতামাতা বিষয়টি বুঝবার আগেই হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে।

দুই. ছাতকের এক গ্রামের “উচ্চ বিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে সোমবার আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা’ (জনকণ্ঠ, ১৯ মার্চ)। প্রশ্ন দু’টি : শহীদ মিনার তো ‘মানুষ নয়’ যে কারো সঙ্গে শত্রুতা করবে, কাউকে আক্রমণ করবে, তাহলে শহীদ মিনারকে আক্রমণ করে, ভাঙে-পোড়ায় কারা? সংশ্লিষ্ট খবরে বলা হয়েছে ‘দুর্বৃত্তরা’Ñ এই দুর্বৃত্তরা কি অদেখা-অপরিচিত বাংলাদেশের মানুষের? বিভিন্ন লেবাসে-সুরতে-পরিচয়ে ওদেরকে বারাবার দেখা গেছে। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে বেশ ক’জন ছাত্র-জনতা শহীদ হলে ছাত্রছাত্রীরাই নিজস্ব আবেগে-উদ্যোগে একটি অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করেছিল। কিন্তু রাতের আঁধারে সরকারের পুলিশ-পেটোয়ারা সেটি ভেঙে দিয়েছিল। একটি কথা মনে রাখতেই হবে, বাঙালি হলেই শহীদ মিনারকে সম্মান করবে বা বাংলাদেশকে ভালোবাসবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। সেদিন প্রাদেশিক সরকার প্রধান ছিলেন বাঙালি নুরুল আমিন আর কেন্দ্রে ‘ঢাকার সন্তান’ নাজিমউদ্দিন।

শহীদ মিনার আবার ভেঙেছিল ২৫ মার্চ ১৯৭১ রাতেই ইয়াহিয়া-টিক্কার মিলিটারিরা। পাকসেনা আর ধর্ম-ব্যবসায়ী রাজনীতিকরা বলতো শহীদ মিনার হচ্ছে ‘বেদাতি’ করার স্থান, অনৈসলামিক। এ কথা তো কারো ভুলে যাবার কথা নয় যে, জামাত-পাকসেনারা একাত্তরে এক কাতারে ধর্মরক্ষা-দেশরক্ষায় দাঁড়িয়েছিল। সুতরাং পাকসেনাা ‘পয়লা রাতেই’ শহীদ মিনার ভেঙে জামাতিদের অধিকতর বশ করে হুকুমের দালাল বানিয়ে সব রকমের কুকর্ম-অপকর্ম করাতে পেরেছিল। সেই ইতিহাসের দায়ভার এখন জামাতিদের কাঁধে চেপেছে, দালাল-যুদ্ধাপরাধীর বিচার চলছে। সুতরাং আচরণে-অপকর্মে তারা যদি একাত্তরের পুনরাবৃত্তিই ঘটায় বিস্ময়ের কিছু নেই। তবে বিস্ময় লাগে, যখন ‘মুক্তিযোদ্ধার দল’ দাবিদার হয়েও কেউ জামাত-সহযোগিতায় সকল সীমানা ছাড়ায়।

মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে স্মরণ রাখা অপরিহার্য যে, মুক্তিযুদ্ধ এমন কোনো ঘটনা নয়, যা একাত্তরেই শুরু এবং শেষ হয়ে গিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাও এমন কোনো ঠুনকো পরিচয় নয়, যার দায়িত্ব একাত্তরেই শেষ আর গৌরব-সম্পদ ব্যবহার্য পুত্র-পুত্রাদিক্রমে। রাজাকার-আলবদর আর মুক্তিযোদ্ধার মৌলিক পরিচয়-সূত্রেই অনস্বীকার্য ফারাক রয়েছে। একদার দলাল-রাজাকার সর্বদাই দালাল-রাজাকার, ব্যতিক্রম না ঘটলে পরিচয়টা অমোচনীয়। অপরদিকে ‘একদার মুক্তিযোদ্ধা’ কখনো ‘চিরকালের মুক্তিযোদ্ধা’ নয়। মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়টা ততোক্ষণই থাকে, যতোক্ষণ গৌরবের দায়দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার অটুট থাকে। প্রসঙ্গতই স্মরণীয় শওকত ওসমানের অমোঘ উক্তি : “এভরি হারলট ওয়াজ ভার্জিন ওয়ানস’।

বায়ান্ন আর একাত্তরের পর এখন আবার শহীদ মিনার অপবিত্র-আক্রান্ত-বিধ্বস্ত করা হচ্ছে। সেটা কিন্তু নিতান্তই অকারণ নয়। শহীদ মিনার বাঙালির শোকের এবং দ্রোহের প্রতীক, বিজয়-গৌরবেরও। শহীদ মিনার বাঙালির শক্তি-শপথের উৎসস্থল। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির গৌরবের উজ্জ্বলতম উৎস হলেও এ কথা সত্য যে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে বলা হয়, ‘আনফিনিশড রিভল্যুশন’Ñ এবার দু-হাজার তেরোয় বাংলার তরুণ প্রজন্ম জাগ্রত-সমবেত হয়েছে গণজাগরণ মঞ্চে একাত্তরের অসমাপ্ত করণীয় সমাপ্ত করার প্রতিজ্ঞায়। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি আবার আক্রমণকারী হয়েই সামনে দাঁড়াবে, ভাঙবে শহীদ মিনার, খামছে ছিঁড়বে পতাকাÑ এটাই স্বাভাবিক। একাত্তরের তরুণ মুক্তিযোদ্ধার সকল প্রতিক্রিয়ার শক্তিকে পরাজিত করেই বিজয় এনেছিল, এবারো তার পুনরাবৃত্তি অনিবার্য, সংশয়ের কোনো কারণ নেই।

তিন. যারা চাঁদে ‘দেলু রাজাকারের ছবি’র গুজব রটাতে পারে, জাতীয় মসজিদকে অপ-রাজনীতির ঘাঁটি বানায়, নিজেরা নিজেদের ধর্মগ্রন্থের অবমাননা করে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর অমানবিক আক্রমণ চালায়, তারা ‘ককটেল মেরেছে মসজিদ সংলগ্ন এলাকায়’Ñ এমন খবরে প্রকৃত ধর্মপ্রাণ মানুষ ব্যথিত হলেও বিস্ময়ের তো কিছু নেই। ওরা তো গুজব ছড়ানোর পরিকল্পিত প্রয়োজনে পবিত্র কাবা শরিফের গিলাফ বদলের ছবিকেও প্রকাশ-প্রচার করতে পারে দেলু রাজাকারের শাস্তির ‘প্রতিবাদী মানববন্ধন’ হিসেবে, তাদের অসাধ্য অপকর্ম কিছু আছে বলে ভাবাও তো সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই ধর্মপ্রাণ আর এখানে শতকরা ৯০ জন মানুষ মুসলমান। অথচ শুধু জামাতিরা নয়, তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ের উৎস বিএনপির নেত্রী গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে বলার মতো যুক্তিসঙ্গত কথা খুঁজে না পেয়ে, ঢালাও ‘ফতোয়া’ দিলেন ওরা নষ্ট চরিত্রের নাস্তিক। এ যাবৎ ‘নাস্তিক ফতোয়া’ দিতেন গ্রাম্য ধর্ম-ব্যবসায়ীরা, এবার দিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব বিএনপি-নেত্রী খালেদা জিয়া। বিস্ময়ের বা দুঃখের হচ্ছে এটাই। ‘ফতোয়া’ এতোকাল অপব্যবহৃত হয়েছে পল্লীসমাজের সরল ধর্মপ্রাণ মানুষকে নির্যাতন-পীড়নের প্রয়োজনে, এবার জাতীয় রাজনীতির পরিম-লে সেটারই অপপ্রয়োগ ঘটানোর সুযোগ সৃষ্টি করলেন বেগম জিয়া।

কোনো ধর্মপ্রাণ মানুষ কি অপরকে ‘নাস্তিক-মুরতাদ’ বলতে পারে? বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং কলামিস্ট অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বড় দুঃখ-ক্ষোভেই বলেছেন, “শাহবাগের অংশগ্রহণকারীদের গণহারে বেগম জিয়ার নাস্তিক ও মুরতাদ বলাতে আমিৃ অবাক হইনিৃ এই দুটি শব্দের অর্থ জানার মতো জ্ঞান তার আছে বলে আমার মনে হয় না।ৃ আমি তো সময় পেলেই শাহবাগ চত্বরে যাই। আমি নিজেকে বেগম জিয়ার চাইতে কোনো অংশে কম মুসলমান মনে করি না।ৃ ওই চত্বরের অনেককে দেখেছি সেøাগান বন্ধ করে নামাজের সময় হলে পাশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে নামাজ পড়তে যেতে। এদের মাঝে অনেক ব্লগারও আছেন” (জনকণ্ঠ, ১৮ মার্চ)। এর পরে আর তেমন কিছু বলার থাকে না। তবু গণজাগরণ মঞ্চের ৪০তম দিনে মঞ্চের অন্যতম প্রধান মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার বেগম জিয়ার উদ্দেশ্যে যা বলেছেন, সেটি উদ্ধৃত করা যেতে পারে। “আপনার ভাষায় এই নাস্তিক আর নষ্ট ছেলেরাই দেশকে স্বাধীন করার জন্য অস্ত্র ধরেছিল। এখন তারা মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত অর্জন পুনরুদ্ধারের জন্য মাঠে নেমেছে। সিদ্ধান্ত আপনার। আপনি আমাদের পাশে, না খুনি-ধর্ষক জামাত-শিবিরের পাশে দাঁড়াবেন” (জনকণ্ঠ, ১৭ মার্চ)।

চার. শুরুতেই উদ্ধৃত খবরসমূহের একটি হচ্ছে : ‘কালীমন্দিরে আগুন’। পাকপন্থী রাজনীতির জামাত-শিবির এবং তাদের সহযোগী-ম“কারীদের দিক থেকে এটাও নতুন নয়, পৌনঃপুনিকতার সাম্প্রতিক উদাহরণ মাত্র। পাক-আমলে সংখ্যালঘুদের বলা হতো সংখ্যাগুরুর হাতে ন্যস্ত ‘পবিত্র আমানত’। যদিও যখন-তখন ইচ্ছামতো সেই আমানত ‘খেয়ানত’ করা হতো। এখন পুরাতন সবিশেষ বিশেষণ ‘পবিত্র আমানত’ নেই, তবে সংখ্যালঘু বিশেষ্যটি বহুল ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তাই এখন খেয়ানতের দায়ভাগি না হয়েও যখন-খুশি যাচ্ছেতাই করা চলে। বারবার ঘটেছে, এখনো ঘটছে। এ বিষয়ে উদাহরণ-উপমা না দিয়েই একটি প্রসঙ্গ স্মরণ করা যেতে পারে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে পাকসেনা চক্র ‘অপারেশন সার্চ-লাইট’ প্রণয়নের সময় ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা ছিল, বেশুমার হিন্দু মেরে যদি বাকি হিন্দুদের ভারতে পাঠিয়ে দেয়া যায়, তাহলে ওরা গিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধালে ভারত থেকে বেশ কয়েক লাখ মুসলমান চলে আসতে বাধ্য হবে। ওদেরকে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস করতে দিলে এখানকার মানুষ স্বাধীনতার স্বপ্ন ভুলে যুগ যুগ ধরে পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভৃত্যের মতো আচরণ করবে। এখনো কেউ তেমনি ভাবেন কিনা জানি না।

শুরুতেই একটা উপ-শিরোনামের উল্লেখ করা হয়েছে, হরতাল-পক্ষীয়রা ‘ইট ছুড়ে হত্যা করেছে ট্রাকচালককে’। এটাও করেছে ‘দুর্বৃত্তরা’ই, তবে তাদের পরিচয়টা কী একেবারেই অজানা? এমন তো কতোই হলো কতোবার। হরতাল সফল করতে বাসের ভেতরে চালক এবং যাত্রী পুড়িয়ে মারা হয়েছে। নববর্ষের অনুষ্ঠানে রমনায়, উদীচীর অনুষ্ঠানে যশোরে, মুন্সীগঞ্জে গির্জায়, রামু-উখিয়ায় বৌদ্ধ মন্দিরে যা ঘটানো হয়েছে, তারই পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে এখন। ময়মনসিংহে ঈদের দিনে সিনেমা হলে বোমা হামলা করে মানুষ মেরে ‘আসামি’ করা হয়েছিল হলের মালিককেই। আগস্ট, ২০০৪ বঙ্গবন্ধু এভিনিউর প্রকাশ্য জনসভায় গ্রেনেড হামলা করে শেখ হাসিনাকে হত্যার অপচেষ্টা করা হয়েছিল। তিনি বেঁচে গেলেও আইভী রহমানসহ ২৪ জন নিহত হয়েছিলেন, আহত-পঙ্গু অনেক। প্রায় সব ক’টি ঘটনাতেই বেগম জিয়া অভিযোগের তীর ছুড়েছেন আওয়ামী লীগের দিকেই। যদিও শাক দিয়ে মাছ ঢাকা কখনো সম্ভব হয়নি, চেষ্টা তবু থামে না।

আজকের এ বিক্ষিপ্ত লেখাটি একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন দিয়েই শেষ করতে চাই, আশা করি ভোরের কাগজের পাঠকরা নিজের মনেই ভেবে দেখবেন। ১৯৪৯-এ জন্মের পরই আওয়ামী লীগ চরম আক্রমণের শিকার হয়েছিল নাজিমুদ্দিন-বগুড়া চক্রের। আইয়ুবের সামরিক শাসনে নির্যাতন-নিপীড়নের প্রধান লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগ আর ব্যক্তি হিসেবে বঙ্গবন্ধু মুজিব। সেনাশাসক ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগ আর বঙ্গবন্ধুকেই বলেছিলেন দেশদ্রোহী। আইয়ুব-ইয়াহিয়া দু’জনেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে নিষ্কৃতি পেতে চেয়েছিলেন। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা বলেছিল ভারতের-দালাল মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। এখনো প্রাণঘাতী গুলি-গ্রেনেড এবং অশোভন সমালোচনার গালিও ছুটে আ.লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার দিকেই। কিন্তু কেন?

১৯ মার্চ ২০১৩

এস আর চৌধুরী : কলামিস্ট।

ভোরের কাগজ : বৃহস্পতিবার, ২১ মার্চ ২০১৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন