বুধবার, ৩ এপ্রিল, ২০১৩

‘মুজাহিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত’

চিফ ল’ ও স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ঢাকা: আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে তদন্তকালে ফরিদপুর জেলাসহ সমস্ত বাংলাদেশে বেসামরিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নরহত্যা, গণহত্যা, বিতারণ, আটক, শারিরীক নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুন্ঠন, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ব্যক্তি সমষ্টিকে সম্পূর্ণ বা আংশিক হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থেকে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তার অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয় বলে জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক খান।

মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দানকালে জেরার আসামিপক্ষের জেরার জবাবে তিনি এ কথা বলেন। মুজাহিদের বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক খান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ গত বৃহস্পতিবার সাক্ষ্য দেওয়া শুরু করে মঙ্গলবার ২ কার্যদিবেসে শেষ করেন। তিনি মুজাহিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ১৭তম ও শেষ সাক্ষী।

সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক খানকে আসামিপক্ষের জেরাও শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার আংশিক জেরার পর আগামী ৭ এপ্রিল পর্যন্ত জেরা মুলতবি করেছেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।

আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট গাজী এইচ এম তামিম তদন্ত কর্মকর্তাকে জেরা শুরু করেন।

জেরায় তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘‘মামলাটি আমি সরেজমিনে তদন্তকালে প্রাপ্য সাক্ষ্য এবং দালিলিক প্রমাণাদিতে জানতে পারি, মুজাহিদ জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ১৯৬৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ফরিদুপর জেলার সভাপতি, ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকা জেলা ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি, একাত্তরের জুলাই মাস পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক এবং ৭১ সালের অক্টোবর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ও পূর্ব পাকিস্তান আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনী ও তাদের অপরাপর সহযোগী বাহিনী দ্বারা ফরিদপুর জেলাসহ সমস্ত বাংলাদেশে বেসামরিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নরহত্যা, গণহত্যা, বিতারণ, আটক, শারিরীক নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুন্ঠন, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ব্যক্তি সমষ্টিকে সম্পূর্ণ বা আংশিক হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থেকে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তার অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়। এগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট ১৯৭৩’র ৩(২)ধারার অধীনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ।’’

তিনি বলেন, ‘‘এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন আমি ট্রাইব্যুনালের বিচারের উদ্দেশ্যে চিফ প্রসিকিউটর বরারব দাখিল করি। তবে এই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পরেও আমি মুজাহিদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত সাক্ষী-প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা অব্যাহত রাখি। অতিরিক্ত সাক্ষ্য হিসেবে পরবর্তীতে তিনজন সাক্ষীর জবানবন্দি চিফ প্রসিকিউটরের কাছে জমা দেই।’’

এর আগে সাক্ষ্য দানকালে তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক তদন্ত চলাকালীন সময়ে জব্দকৃত বিভিন্ন বই, দলিলাদি ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেন।

মুজাহিদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষের আরও ১৬ জন সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। তাদের মধ্যে ঘটনার সাক্ষীরা হলেন, লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, মুক্তিযুদ্ধকালে গেরিলা বাহিনীর সদস্য জহিরউদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালাল, সাংবাদিক মাহবুব কামাল, শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে সাংবাদিক শাহীন রেজা নূর, মো. রুস্তম আলী মোল্লা, আব্দুল মালেক মিয়া, রঞ্জিত কুমার নাথ ওরফে বাবুনাথ, মীর লুৎফর রহমান, একেএম হাবিবুল হক মুন্নু, ফয়েজ উদ্দিন আহমেদ, চিত্তরঞ্জন সাহা ও শক্তি সাহা। আর জব্দ তালিকার সাক্ষীরা হলেন, বাংলা একাডেমীর সহকারী গ্রন্থাগারিক মো. এজাব উদ্দিন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রধান ডকুমেন্টশন কর্মকর্তা আমেনা খাতুন ও জাতীয় জাদুঘরের সংরক্ষক স্বপন কুমার।

আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাদের জেরা সম্পন্ন করেছেন।

গত বছরের ২১ জুন মুজাহিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ৭টি ঘটনাসহ ৩৪টি অভিযোগে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল-২। ১৯ জুলাই মুজাহিদের বিরুদ্ধে ২৯ পৃষ্ঠার ওপেনিং স্টেটমেন্ট (সূচনা বক্তব্য) উত্থাপন করেন রাষ্ট্রেপক্ষের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল ও মীর ইকবাল হোসেন।

অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে, শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেনসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা, সাধারণ মানুষ হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও দেশত্যাগে বাধ্য করা ইত্যাদি। মুজাহিদ একক ও দলবদ্ধভাবে সরাসরি জড়িত থেকে ও নেতৃত্ব দিয়ে কিংবা সহযোগিতা ও নির্দেশ দানের মাধ্যমে এসব ঘটনা ঘটান বলে অভিযোগে বলা হয়েছে। 

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগের মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে গ্রেফতার করা হয়। ওই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।

গত বছরের ১৬ জানুয়ারি মুজাহিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল-১ এ ১০৯ পৃষ্ঠার ৩৪টি বিভিন্ন ঘটনাসহ মোট ছয় হাজার ৬৮০ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগে মুক্তিযুদ্ধের সময় ফরিদপুর ও ঢাকাসহ সারা দেশে সাধারণ মানুষকে হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয় মুজাহিদের বিরুদ্ধে। ২৬ জানুয়ারি এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।

প্রসিকিউশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক মামলাটি দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন