বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৩

সম্প্রীতির বাণীই রুখে দেবে সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে

ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ
দেশে বর্তমানে জামাত ও ইসলামী ছাত্রশিবির কয়েকদিন ধরে একাধিক নৃশংস তা-বলীলা চালাচ্ছে। এই নৃশংসতার সঙ্গে বিএনপি যুক্ত হয়ে প্রমাণ করেছে তারাও যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়ের পর থেকে বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে যে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা দেশের জন্য যেমন দুঃখজনক তেমনি এ অরাজকতার ভার আজ হোক কাল হোক বিএনপি-জামাতকেই নিতে হবে। পৃথিবীর বুকে আমরা যে সভ্য মানুষ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলাম গত কয়েকদিনের তা-বে তা ধুলায় মিশে গেছে। তা-বের ভয়াবহতায় ৭০ থেকে ৮০ জন মানুষই মৃত্যুবরণ করেনি পুলিশ বাহিনীর সদস্যও মারা গেছে অন্তত ১০ জন। যে কোনো মানুষের মৃত্যু কোনোভাবেই কাম্য নয়।
কিন্তু অন্যায়ভাবে আক্রমণ হলে আত্মরক্ষার চেষ্টা অবশ্যই করতে হবে। তারা নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন এটাই ছিল পুলিশের অপরাধ। অন্যদিকে যারা সংঘর্ষে লিপ্ত হলো এবং জীবন দিলো তারাও ভুলমন্ত্রে বশীভূত হয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে কোনো কোনো পরিবারের কোল শূন্য করলো। এই কুমন্ত্রণাদাতাদের বিরুদ্ধে আজ দেশবাসীর সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে।

জামাত-শিবিরের যারা নিরীহ সাধারণ মানুষকে হত্যা করার জন্য উসকে দিচ্ছে, জানমালের ক্ষয়ক্ষতির তা-ব চালিয়েছে আবার ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের জানমাল সংহার ও বসতভিটা, তাদের মন্দির ধ্বংস করা এবং পুরোহিতকে হত্যা করতে উসকে দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আসলে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা এখনো চোখে পড়ছে না। শুধুমাত্র যারা অন্যায় প্রতিরোধ করতে যাচ্ছে তারা নিগৃহীত হচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির দ্বারা। দৃশ্যত সাধারণ মানুষের মনের মাঝে এখন এটাই প্রশ্ন। আমিও সাধারণ মানুষের দলে। তারপরও বলবো, এ অপকা- রুখতেই হবে।

গত কয়েকদিনের প্রলয়ঙ্করী তা-বে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। জাতীয় দৈনিক কালের কণ্ঠের হিসাব অনুযায়ী শুধু রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি হয়েছে ২২৫ কোটি টাকা। বেসরকারি সম্পদের হিসাবের ক্ষতি এখনো নির্ধারণ করা যায়নি। আর সাধারণ মানুষের জানমাল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দুষ্কৃতকারীদের প্ররোচনায় ও গুজবে। এভাবে হরতালের পর হরতাল দিয়ে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙে ফেলা হচ্ছে, বিদেশে রপ্তানি পণ্য সময়মতো প্রেরণ করা যাচ্ছে না। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য আজ ধ্বংসের মুখে। আর এই ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের মূলে আমরা জামাত-শিবিরকেই দেখতে পাচ্ছি।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামসরা যেভাবে এদেশের সবাইকে কাফের বলে আখ্যায়িত করেছিল, এবারো দেশের যে সব মানুষ তাদের হঠকারী ও অন্যায় আচরণে সমর্থন দেয়নি তাদের মুরতাদ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি একাত্তরে যেভাবে রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছিল, ব্রিজ ধ্বংস করা হয়েছিল, লুটপাট-অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিলÑ সে ধরনের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি এখন ঘটাচ্ছে জামাত-শিবির। তাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিএনপি এসবে উৎসাহ জোগাচ্ছে বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষ। অনেকেই এমন অভিযোগ তুলে জামাতের সহযোগিতার জন্য বিএনপির প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। কোনো শুভবুদ্ধির মানুষ এ ধরনের বর্বরতাকে সমর্থন করতে পারে না। গত কয়েকদিনের তা-বে যে প্রাণগুলো ঝরে গেলো, সে যে দলেরই হোক, তার দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করবে কে? সব হিসাব-নিকাশ শেষে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় এই দায়দায়িত্বের ভার শেষ বিচারে জনগণ বিএনপি-জামাতের ওপরই ফেলবে।

বাংলাদেশের সব ধর্মের, বর্ণের, গোত্রের ও উপজাতি সবার সহাবস্থান পৃথিবীর যে কোনো দেশের জন্য অনুকরণীয়। এদেশের প্রতিটি মানুষের নিজস্ব ধর্ম নিয়ে বাঁচার অধিকার আছে। মানুষ যাতে ধর্মীয় ব্যাপারে হিংসাত্মক হয়ে ওঠে সে জন্য জামাত-শিবির ধর্মকে বিকৃত করে মানুষের মগজ ধোলাইয়ের মিশনে নেমেছে। আশির দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের তা-ব দেখেছি। এর কিছুদিন পড়ে দেখেছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্বাধীনতা যুদ্ধেও তাদের পূর্বসূরিদের অত্যাচার ও তা-ব মানুষ ভোলেনি। জামাতের এই তা-ব কখনো বন্ধ হয়নি। এই ঘৃণিতদের ব্যবহার করে বিভিন্ন দল বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় যেতে সচেষ্ট হয়েছে। মাঝখান থেকে এরা দিনে দিনে হয়েছে ক্ষমতাবান। প্রশাসনে এখন একচ্ছত্র আধিপত্য তাদের। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও তারা তাদের ডালপালা বিস্তৃত করছে। বেসরকারি নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন ছাত্র একজন ব্লগার একটিভিস্টকে হত্যার পর ধরা পড়েছে। কেবল নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনেক কোমলমতি তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের ভুল ব্যাখ্যা ও শিক্ষা দিয়ে জামাত তাদের নৈতিকতায় আঘাত হেনেছে। তাদের কিলিং মিশনে অংশ নেয়ার জন্য প্ররোচিত করছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে যে ধরনের আত্মঘাতী পথে নিয়ে যাচ্ছে তা যদি এখনই মোকাবেলা করা না যায় তাহলে তা সরকারের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

অন্যকে হত্যা করে কখনো মানবিকতা প্রকাশ পায় না। বরং এটি পশু আচরণ। জামাত কয়েকদিন ধরে যা করছে তা পশুত্বের পরিচায়ক। এদেশে মানুষের মধ্যে যে অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিদ্যমান তা নষ্ট করে দিতে চাচ্ছে জামাত। অসাম্প্রদায়িকতা মানে ধর্মহীনতা নয়। আবার ধর্মান্ধতা ও ধর্মভীরুতা এক নয়। এদেশের ধর্মভীরু মানুষকেই ধর্মের দোহাই দিয়ে জামাত মানুষ হত্যার মিশনে নামিয়েছে। এভাবে আর কতো হিংস্রতা জামাত-শিবির ও তার পৃষ্ঠপোষকরা প্রদর্শন করবে?

ছলচাতুরী জামাতের একটি পুরোনো অস্ত্র। এবার যুদ্ধাপরাধী হিসেবে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর চেহারা চাঁদে দেখা গেছে বলে নতুন ছলচাতুরীর আশ্রয় নেয় তারা। সরলমনা জনগণ এতে কিছুটা হলেও বিভ্রান্ত হয়। এই বিভ্রান্তিপূর্ণ খবর কোনো কোনো স্থানে মসজিদ থেকেও মাইকে ঘোষণা করা হয়। কারা মাইকে এ ধরনের ঘোষণা দিয়ে সাধারণ মানুষকে মৃত্যুর মিছিলে এনে দাঁড় করিয়েছে সরকার এখনো তাদের খুঁজে বের করতে পারেনি। এটা যে জামাতের কাজ তা এখন বোঝার কারোরই বাকি নেই। সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও যে বিষয়টি বোঝেনি তাও নয়। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নিতে না দেখে মানুষের মনে প্রশ্ন জেগেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই নিস্পৃহতায়।

দারিদ্র্যের কারণে এদেশের জনগণকে বিশেষ করে মাদ্রাসা ছাত্রদের সহজেই জঙ্গি বানানোর টোপে ফেলা যায়। এভাবে অনেক কোমলমতি ছাত্র জঙ্গি বনে যায়। নর্থ সাউথের পাঁচ জন ছাত্র এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অথচ যারা এই সরলপ্রাণ ছাত্রদের বিভ্রান্ত করেছে ও করছে তাদের আইনের আওতায় নেয়া হচ্ছে না। জামাত এখন পুলিশ বাহিনীকে টার্গেট করার পাশাপাশি বিজিবিকেও টার্গেট করছে। পুলিশ স্টেশনগুলোও ওদের টার্গেটে। ওদের হাতে ভারী অস্ত্র থাকাটাও বিচিত্র নয়। এটি দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর হুমকিস্বরূপ। এভাবে মিথ্যের বেসাতি করে, হিংস্র তা-ব চালালে মানবতা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। এখন সময় এসেছে দল-মত-নির্বিশেষে সবার শুভবুদ্ধির উদ্রেক হওয়া। এদেশের বেশিরভাগ মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চান। অথচ কিছু উচ্চাভিলাষী ও ক্ষমতালোভীরা বছরের পর বছর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আটকে রেখেছে। এই বিচার আটকে রাখা যতো প্রলম্বিত হবে, আমাদের অস্তিত্ব ততোই বিপন্ন হবে।

দেশে জামাত তাদের ঘোষণা অনুযায়ী গৃহযুদ্ধ পরিচালনা করছে। এর অংশ হিসেবে তারা এবং পৃষ্ঠপোষক বিএনপি দেশে একের পর এক হরতাল দিচ্ছে। এ হরতাল, আসলে কার বিরুদ্ধে? হরতালের ফলে দেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। কর্মজীবীরা স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারছে না। গত কয়েক বছরে দেশের জিডিপির হার যেভাবে বাড়ছিল তাকে ধ্বংস করার জন্য এটি একটি জামাতি এবং বিএনপির নীলনকশা। আজ যারা এ দেশকে পিছিয়ে দিতে চাচ্ছেন, ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাচ্ছেন, তাদের এ ধরনের ইগো থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। জামাতকে বাদ দিয়ে বিএনপির উচিত সরকারি দলের সঙ্গে আলোচনায় বসা। আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি করা বাঞ্ছনীয়। নইলে এ জামাত প্রীতিতে মোহগ্রস্ত হয়ে জনগণের বিপক্ষে থাকার জন্য বিএনপিকেই খেসারত দিতে হবে।

স্বাধীনতা সংগ্রামের মাসে একাত্তরের হায়েনাদের আক্রমণে জর্জরিত হয়েছিল দেশ। আবার আরেক মার্চে ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষে মানুষে বৈরীভাব তৈরির অপপ্রয়াসে নেমেছে তারা। ৭ মার্চের ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের স্বাধীনতার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেখানে মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম সুযোগ করে দেয়ার দাবি জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছিলেন। আজ সেই স্বাধীন বাংলাদেশে যখন সরলপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয়, ব্যক্তিগত ও সরকারি স¤পত্তি, গাড়ি-বাড়ি জ্বালিয়ে ছারখার করা হয় তখন কষ্ট লাগে। দেশের স্বাধীনতাপ্রিয় সকল মানুষ আজ সে ব্যথায় জর্জরিত।

যারা মিথ্যে ছলনার আশ্রয় নিয়ে দেশে তা-বলীলা চালাচ্ছে, বিভিন্ন উপাসনালয় ধ্বংস করছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করছে এবং জানমালের নিরাপত্তা বিনষ্ট করছে তাদের বিরুদ্ধে সরকারের সঙ্গে দেশবাসীকেও সমান সোচ্চার হওয়া জরুরি। বিদেশী গণমাধ্যমে সঠিকভাবে সংবাদ উপস্থাপন করা হচ্ছে না। এ বিষয়ে সরকার এখনো গুরুত্বের সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। যারা মানবতাবিরোধী বিচারের জন্য সক্রিয় তাদের এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। নইলে বিদেশী গণমাধ্যম জামাতের পক্ষেই প্রপাগান্ডা চালাতে থাকবে। বিদেশী গণমাধ্যমে সঠিক সংবাদ পরিবেশনের জন্য বর্তমান প্রজন্মের দক্ষ সাংবাদিকদেরও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া দরকার।

এদেশের সাধারণ মানুষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী। শান্তির প্রশ্নে তারা সবসময় অমিত শক্তির অধিকারী। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সব সময়েই তরুণ সম্প্রদায় এগিয়ে এসেছে। এবারো তরুণ সম্প্রদায় শাহবাগ চত্বরে গণজাগরণের সূচনা করেছেন। সবাই সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা গ্রহণ করলে জামাতি পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে বিজয় অর্জিত হবেই। পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায়, মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা ও চার্চে সম্প্রীতির বাণী প্রচারে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলেই ধর্মের মুখোশধারী ইবলিশরা এদেশ থেকে চিরতরে নির্মূল হবে।

ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ : অধ্যাপক, লেখক।
ভোরের কাগজ : বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০১৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন