শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৩

বিচ্ছিন্ন হেফাজত

০ তালেবানী রাষ্ট্র বানানোর পাঁয়তারার বিরুদ্ধে ১১ মে শাপলা চত্বরে তরিকতপন্থীদের মহাসমাবেশ
০ ওলামা মাশায়েখ তৌহিদী জনতা সংগঠিত হচ্ছে
০ রাজপথে নামছে মদিনা সনদের আলোকে প্রতিষ্ঠিত সব ইসলামী দল
বিভাষ বাড়ৈ ॥ জামায়াত-শিবির ও তার প্রকাশনা নিষিদ্ধ, যুদ্ধাপরাধীর বিচারসহ ধর্মের নামে অপকর্মের বিরুদ্ধে রাজপথে নামছেন স্বাধীনতার পক্ষের সকল ইসলামী দল, সংগঠন, ওলামা মাশায়েখরা। মদিনা সনদ তথা ইসলামকে বিকৃত করে ধর্মের নামে জামায়াত-হেফাজতের তালেবানী রাষ্ট্র বানানোর পাঁয়তারার বিরুদ্ধে নামছে আউলিয়া কেরাম, দরগা, মাজার ও খানকা, সুফিবাদী তরিকতপন্থী ও মদিনা সনদের আলোকে প্রতিষ্ঠিত সকল ইসলামী দল। আজ চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে সুন্নি মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে রাজপথে নামছে সুন্নাত ওয়াল জমা’আত। যেখানে থাকবেন তরিকত ফেডারেশনসহ জামায়াতবিরোধী সকল ইসলামী দলের নেতারা। সংগঠিত হচ্ছে ওলামা মাশায়েখ তৌহিদী জনতা সংহতি পরিষদ, সম্মিলত ইসলামী জোট ও বাংলাদেশ ইসলামী জোট। দেশকে তালেবানী রাষ্ট্র বানানোর পাঁয়তারার বিরুদ্ধে আগামী ১১ মে রাজধানীর মতিঝিল শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে দেশের তরিকতপন্থীদের জোট বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন। এভাবে বস্তুতপক্ষে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সত্যিকারের ইসলামপন্থীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।
দলগুলোর নেতৃবৃন্দ, আলেম ওলামাসহ ইসলামী চিন্তাবিদরা কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, যুদ্ধাপরাধী ইসলাম বিকৃতকারী সন্ত্রাসী জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা এখন জনগণের প্রাণের দাবি। কোন দল জামায়াতকে রক্ষা করতে পারবে না। জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধসহ জঙ্গী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন মৃত্যু পর্যন্ত চলবে। কারণ জামায়াত কোন ইসলামী দল নয়, ইসলামের আসল শত্রু, এজিদের উত্তরসূরি। জামায়াত একাত্তরেও ইসলামের অপব্যাখ্যা করে গণহত্যা চালিয়েছে, ধর্ষণ করেছে এবার আবার আঘাত হানতে চায়। জামায়াতের কারণে দুর্নামের ভাগীদার ইসলাম। জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে রাজপথে নামতে সাধারণ মুসল্লিদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তারা বলেছেন, ‘সবাই মিলে আসুন আবারও গর্জে উঠি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই, এবার তাদের রক্ষা নাই।’ জামায়াতের টাকায় হেফাজত চলছে অভিযোগ করে তারা বলেছেন, জামায়াতের কাছ থেকে প্রায় একশ’ কোটি টাকা নিয়ে হেফাজতে ইসলাম লংমার্চ করেছে এবং আগামীতে সাধারণ মুসল্লিদের দিয়ে একই অপকর্ম করতে চায়। নাস্তিক আর হেফাজত নেতারা একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। তাদের উদ্দেশ্য ইসলাম হেফাজত না জামায়াত হেফাজত, তাও আজ জাতির সামনে দিবালোকের মতো স্পষ্ট। হেফাজতের নেতা আহমদ শফী একাত্তরে পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য মুজাহিদ বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানী সেনা আর রাজাকারদের সব কাজে সহযোগিতা করেন। এখন পাকিস্তানের দোসরদের রক্ষার ‘এজেন্ডা’ বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছেন। এদিকে ১৩ দফা দাবিতে আগামী ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচীর আড়ালে রাজধানীকে চারদিক থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে হেফাজতে ইসলাম। সঙ্কট তৈরি এবার ঢাল হিসেবে জামায়াত ও হেফাজত নেতাদের মহিলা মাদ্রাসার নারীদের মাঠে নামানোর অপকৌশল নেয়া হয়েছে। ফটিকছড়ির তা-বের মতো জামায়াত-শিবির ও হেফাজত নেতাকর্মীরা দেশের কিছু স্থানে হামলা চালাতে পারে। তবে হেফাজতের ব্যানারে কওমীপন্থীদের দিয়ে জামায়াতের হয়ে কাজ করা নিয়ে ইতোমধ্যেই মতবিরোধ তৈরি হয়েছে হেফাজতের মাঠ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে। এছাড়া জামায়াতের কাছ থেকে টাকা নেয়ার নানা ঘটনা ফাঁস এবং বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের চিহ্নিত নেতাদের নিয়ে হেফাজতের ব্যানারে কাজ করা নিয়েও তৈরি হয়েছে মতবিরোধ। হেফাজতের ব্যানারে নতুন কর্মসূচী সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগামী ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচীতে সরকারের বিভিন্ন বাধা আসার সতর্কতা হিসেবে জামায়াত-শিবিরকে নিয়ে অচলাবস্থা তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছেন হেফাজতের নেতৃত্বে থাকা ১৮ দলের নেতারা। এর সঙ্গে চলছে দেশের বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ, জরুরী বৈঠকসহ নানান প্রস্তুতি।
সূত্রগুলো বলছে, আগামী ৫ মে ঢাকার চারদিকে হেফাজতের ব্যানারে নেতা-কর্মীরা অবস্থান গ্রহণ করে রেল-সড়ক-নৌপথ আটকে দিয়ে ঢাকার সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগ বন্ধ করে দেবে। গত মঙ্গলবার চট্টগ্রামের হাটহাজারীর মাদ্রাসায় এ বিষয়ে একটি গোপন বৈঠক থেকে ঢাকার সমন্বয় কমিটিকে অবরোধের মাস্টারপ্লান করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। ওই দিন সরকারের বাধাদানে রাজধানীতে প্রবেশে করতে না পারলে পুনর্নির্ধারিত কয়েকটি স্থানে হেফাজতের নেতাকর্মীরা অবস্থান গ্রহণ করবেন। নেতাকর্মীদের অবস্থান পুরো দিন স্থায়ী হবে বলে হেফাজতের ঢাকা মহানগরীর সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। তবে চট্টগ্রামের ১০ আলেম হত্যার পরিকল্পনাকারী জামায়াত-শিবিরের বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ, হেফাজতের অপকর্ম বন্ধসহ বিভিন্ন দাবিতে আজ নগরীর লালদীঘি ময়দানে সুন্নি মহাসমাবেশে কয়েক লাখ লোকের সমাগম হবে বলে আশা করছেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আত’র সমাবেশ আয়োজক কমিটির সদস্য সচিব এ্যাডভোকেট মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার। তিনি বলেন, ‘নবীদ্রোহী ওহাবি-মওদুদীবাদ, মানবতার শত্রু জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ইসলামের মূলধারা সুন্নি মতাদর্শের আলোকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী ঘোষণা ও কোরান œার নির্দেশিত সঠিক পথ জনগণকে দেখিয়ে দিতে এ মহাসমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। নেতারা বলেছেন, শনিবার পুরো চট্টগ্রাম নগরী জনসমুদ্রে পরিণত হবে। আমরা আশা করছি এ মহাসমাবেশে ১০ লাখ লোকের সমাগম হবে। তিনি বলেন, ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আত এ পর্যন্ত শান্তি ভঙ্গ করে কোন কাজ করেনি। মহাসমাবেশও শান্তিপূর্ণভাবে হবে। নাস্তিক’ ব্লগারদের বিষয়ে নেতারা বলেছেন, আমরা কোন মতবাদের বিরুদ্ধে নই। ‘নাস্তিক’ বলে যারা পরিচিত তাদেরও একটা বিশ্বাস আছে সে বিশ্বাসের বিরুদ্ধে আমরা নই। বরং আমরা আল্লাহ ও নবীর শানে যারা কটূক্তি করেছে তাদের শাস্তি চাই। পাশাপাশি যারা ধর্মের নামে অশান্তি সৃষ্টি করেছে তাদের আরও কঠোর শাস্তি চাই। কারণ তারা নাস্তিকদের চেয়েও ভয়াবহ। আর হেফাজতে ইসলাম দেশে শান্তির নামে অশান্তি সৃষ্টি করেছে। হেফাজতে ইসলাম জঙ্গীবাদের সঙ্গে যুক্ত অভিযোগ করে তারা বলেছেন, হেফাজতে ইসলামের নেতারা আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে জঙ্গীবাদী প্রশিক্ষণ নিয়েছে। প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে তারা দেশবিরোধী সেøাগান দিয়েছিল। অথচ ইসলাম হানাহানি, মারামারি, দেশে অরাজক পরিস্থিতি সমর্থন করে না। মহাসমাবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট। মাসব্যাপী সিরিজ কর্মসূচী নিয়ে নামছে মহাজোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট। সংগঠনটির চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান চৌধুরী বলেছেন, কর্মসূচীর মধ্যে আছে ওলামা মাশায়েখ সম্মেলন, ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণে চারটি সমাবেশ ও ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে মহাসমাবেশ। জামায়াত ডে-লেবার হিসেবে লোক ভাড়া করে সারাদেশে সংঘাত সৃষ্টি করছে এমন অভিযোগ করে মিছবাহুর রহমান বলেন, জামায়াত পূর্ব পরিকল্পিতভাবে সাঈদীর রায় ঘোষণার পর দেশব্যাপী নজিরবিহীন তা-ব শুরু করেছিল। এজন্য তারা বিপুল অঙ্কের টাকা ব্যয় করেছিল। তাই তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। হেফাজতে ইসলামের নেতা মাওলানা আহমদ শফী বার্ধক্যের কারণে ইসলামী আন্দোলনের প্রকৃত চিত্র জানেন না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ঢালাওভাবে মানুষকে নাস্তিক, মুরতাদ বলা ইসলাম অনুমোদন করে না। মহাসমাবেশের পর নতুন কর্মসূচী নিয়ে মাঠে নামছে ওলামা মাশায়েখ তৌহিদী জনতা সংহতি পরিষদ। চেয়ারম্যান এবং ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগার ইমাম ও খতিব আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ ওলামা-মাশায়েখ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তিকে ’৭১-এর মতো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘জামায়াত শুধু যুদ্ধাপরাধীই শক্তি নয়, এরা ইসলামেরও শত্রু। চলুন, সবাই মিলে আবারও গর্জে উঠি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই, এবার তাদের রক্ষা নাই।’ দেশকে তালেবানী রাষ্ট্র বানানোর পাঁয়তারার বিরুদ্ধে আগামী ১১ মে রাজধানীর মতিঝিল শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে দেশের তরিকতপন্থীদের জোট বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন। ফেডারেশনের মহাসচিব লায়ন এম এ আউয়াল জানিয়েছেন, ১১ মে সত্যিকারের ইসলাম ও মদিনা সনদের পক্ষে ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে লাখ লাখ লোকের মহাসমাবেশ হবে। আমাদের পোস্টার তৈরিসহ অন্যান্য কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। জানা গেছে, পোস্টারে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি ছাড়াও লেখা থাকবে, ‘দেশকে তালেবানী রাষ্ট্র বানানোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন।’ ফেডারেশনের চেয়ারম্যান আলহাজ সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেছেন, যুদ্ধাপরাধী ইসলাম বিকৃতকারী মানবতা-বিরোধী সন্ত্রাসী জামায়াতের ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ এ দেশের জনগণের প্রাণের দাবি। ইসলাম বিকৃতকারী জামায়াত এদেশের সহজ সরল মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মুক্তিকামী মানুষ হত্যা নারী ধর্ষণ, গণহত্যা, লুটপাট জ্বালাও পোড়াওসহ এমন কোন অপকর্ম নেই যা করেনি। এখন যখন তাদের মানবতাবিরোধী অপকর্মের বিচার চলছে তখনও তারা পূর্বের ন্যায় হত্যা, গুপ্ত হত্যা, জ্বালাও পোড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পুলিশ হত্যার মাধ্যমে দেশে একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। তাই এসব ঘৃণ্য অপকর্মের বিরুদ্ধে সচেতন জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ তুলতে হবে। আন্দোলনে নামছে সম্মিলিত ইসলামী জোট। জোটের সভাপতি হাফেজ মাওলানা জিয়াউল হাসান বলেছেন, একাত্তরে যখন পাকিস্তানী সেনা আর তাদের দোসররা এ দেশে হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন চালিয়েছিল, তখন হেফাজতের নেতারা কোথায় ছিলেন? হেফাজতের নেতা আহমদ শফী একাত্তরে পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য মুজাহিদ বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানী সেনা আর রাজাকারদের সব কাজে সহযোগিতা করেন। আহমদ শফী এখন পাকিস্তানের দোসরদের রক্ষার ‘এজেন্ডা’ বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছেন। একই অবস্থান নিয়ে নামছে সুন্নি পীর-মাশায়েখ ঐক্য পরিষদ। এ সংগঠন বলছে, জামায়াতে ইসলামীর টাকায় যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় হেফাজতে ইসলাম কাজ করছে। সংগঠনটি একই সঙ্গে বলেছে, হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনে ১৮ দলীয় জোটের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করে তারা অরাজনৈতিক সংগঠন না। তারা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ আন্দোলন করেছে। সমন্বয়ক হাফেজ মাওলানা আব্দুস সাত্তার হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, যারা এতদিন মওদুদীবাদের ভক্ত জামায়াত-শিবিরকে মুরতাদ বলত তারাই ইসলাম ও দেশের শত্রু জামায়াত-শিবিরের কাছে থেকে প্রায় শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লংমার্চ করেছে। এবার আরও অপকর্ম করতে চায়।
#
জনকণ্ঠ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন