শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৩

‘নতুন মুক্তিযুদ্ধ’ এবং আজকের অস্থির বাংলাদেশ

এস আর চৌধুরী
পুরোনো একটা ‘ভোরের কাগজ’-এর প্রথম পৃষ্ঠায় খবরের শিরোনাম ছিল : “নতুন মুক্তিযুদ্ধ শুরু, রাজাকারদের আর রক্ষা নেই : আওয়ামী লীগ” (২২-০৯-১১)। খবরটিতে বলা হয়েছিল, “জামাত-শিবির রাজাকারদের বিরুদ্ধে নতুন আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেৃআওয়ামী লীগ। নতুন এ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য দেশের সকল প্রগতিশীল মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। তিনি বলেনৃনতুন এ যুদ্ধের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীর বিচার, জাতীয় চার নেতার হত্যার বিচারৃসমস্ত রাজাকারদের শেষ করে এ যুদ্ধে জয়ী হয়ে তবেই আমরা ঘরে ফিরবো”।
“জামাত-শিবির ও বিএনপির সন্ত্রাস নৈরাজ্য-অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুর ও গণবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে” সাজেদা চৌধুরী আরো বলেছিলেন, “বিএনপি-জামাত মিলে বাংলাদেশকে তছনছ করতে চায়।ৃস্বাধীনতাবিরোধী বিএনপি-দোসর জামাত-শিবিরকে অনেকবার ক্ষমা করা হয়েছে। ৃএবার আর তাদের রেহাই নেই। সবাইকে সজাগ থাকতে হবে, রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার যুদ্ধ শুরু হয়েছে।ৃবিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, আবোল-তাবোল ও মিথ্যা বলার দায়িত্ব ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে দেয়া হয়েছে। এরকম বকনেওয়ালা আমরা আগেও দেখেছি”।

সুদীর্ঘ এ উদ্ধৃতি থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষণীয়। প্রথমত, গত দেড় বছর বা অধিককালে পরিস্থিতির কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেনি, বরং ইতোমধ্যে একান্ত নেতিবাচকভাবেই তীব্রতর হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রধানতম রাজনৈতিক শক্তি আ.লীগের মূল যুদ্ধটা ছিল এবং এখনো আছে জামাত-শিবির-রাজাকারদের বিরুদ্ধে, বিএনপির বিরুদ্ধে নয়। এক্ষেত্রে জামাত-শিবিরের প্রতি সহযোগিতার অনিবার্য দায়টাই বিএনপি-বিরোধিতার প্রধানতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারো সমালোচনাকে শত্রুতা বলে গণ্য করে বিএনপি-নেতৃত্বকেই ভাবতে হবে, এ ‘পাপের দায়’ কতোদিন বহন করা সম্ভব হবে? বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের প্রতি আ.লীগ-নেত্রী সাজেদা চৌধুরী ক্ষুব্ধ হয়েই বলেছিলেন, ‘এরকম বকনেওয়ালা’ অতীতেও অনেক দেখা গেছে। আর বর্তমানে চায়ের টেবিলে সকৌতুকে বলাবলি হয়, এ যুগের আগ্রহী এবং পেশাদার ‘গোয়েবলস’দের জন্য একটা প্রশিক্ষণ-কেন্দ্র খুললেও মির্জা আলমগীর সহজেই সফল হতে পারবেন।

দুই. একদা বিএনপি সমর্থন-সহযোগিতা পাবার আশায় ‘লাইসেন্স’ দিয়ে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামাত-শিবিরকে রাজনীতির ময়দানে এনেছিল। এতোকাল বিএনপির প্রত্যক্ষ সহযোগিতাই ছিল জামাতিদের অস্তিত্বের নিয়ামক। কিন্তু এখন দৃশ্যতই খেলাটা পাল্টে গেছে। ‘এতো বড় দল’ বিএনপি এখন জামাতের ইশারা-ইঙ্গিত মেনে চলছে, দৃশ্যতই বাধ্য হয়ে মানছে। এর কারণটাও দুর্বোধ্য নয়, তবে আজ সে আলোচনা মুলতবি থাক। বলছিলাম, বিএনপি এখন জামাত-শিবিরের ইশারা মেনে চলছে, আশা করি কেউ ক্ষুব্ধ হবেন না, বিএনপি এখন আরো পিছু হটেছে। জামাত-শিবির বিএনপির মিছিল-সমাবেশে ‘গোপন অনুপ্রবেশ করে’ অস্তিত্ব রক্ষা করেছে। এখন সেই ভূমিকা নিয়েছে বিএনপি। নবঘোষিত সংগঠন ‘হেফাজতে ইসলামী’র সঠিক পরিচয়টা নিয়ে এখনো বিতর্ক-বিভ্রান্তি রয়েই গেছে। সংগঠক-নেতৃবৃন্দ অবশ্য দাবি করছেন, তাদের অবস্থান জামাত-বিরোধিতার। আমাদের বর্তমান আলোচনায় এ বিতর্ক নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক।

সংগঠনটি সম্পর্কে খবর হচ্ছে, ৬ এপ্রিল লংমার্চের মাধ্যমে “রাজধানী অচল করে দাবি আদায়ের প্রস্তুতি হেফাজতের” (প্র.আ, ১ এপ্রিল,’১৩)। তার পাশেই চমকদার খবরটি হচ্ছে : “হেফাজতের লংমার্চে থাকবেন বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা”। খবরটিতে বলা হয়েছে, “মহাসড়কের পাশের জেলাগুলো থেকে বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের ওই মিছিলে প্রবেশ করতে বলা হয়েছে। তবে বিএনপির পোস্টার ও ব্যানার না নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হেফাজতের কর্মসূচিকে বৃহৎ রূপ দিতে পেছন থেকে বিএনপি এ সহায়তা করছে। ৃএকজন নেতা অবশ্য বলেছেন, এটা কৌশলগত সিদ্ধান্ত। কোনো ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটলে সরকার যেন বিএনপিকে দোষারোপ করতে না পারে, সে জন্যই এ কৌশল নেয়া হয়েছে”। এখানে খুব মোটা দাগের প্রশ্ন হচ্ছে, এমন ‘কাকের চক্ষু বন্ধ’ কৌশলে বিষয়টিকে একই সঙ্গে সরকার, জনগণ এবং সংবাদ মাধ্যমের অজানা রাখা যাবে বলে কি বিএনপি-নেতৃবৃন্দ মনে করেন? নাকি, কারো অজানা রাখা নয়, বরং সময়মতো অস্বীকার করার পথ তৈরিটাই লক্ষ্য?

প্রসঙ্গতই স্মরণ করা যেতে পারে, গত ১১ মার্চ নয়া পল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে বিএনপির সভার শুরু থেকে শেষ ভালোভাবেই চলছিল, অনেক দূর থেকে পুলিশের নজরদারি চলছিল। সভার একেবারে শেষ পর্যায়ে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের বক্তৃতা চলাকালে শুরু হয় মুহুর্মুহু ককটেল বিস্ফোরণ, সঙ্গে সঙ্গে ফখরুল ঘোষণা করেছিলেন, ‘আগামীকাল সারা দেশে হরতাল’। পরের ঘটনার বর্ণনা নি®প্রয়োজন, দেশজুড়ে বিভিন্ন টিভি-চ্যানেলের দর্শকরা সেদিন রাস্তার ওপরে এবং বিএনপি-কার্যালয়ের ভেতরে যা স্বচক্ষে দেখেছেন, ভুলে যাবার কথা নয় ইতোমধ্যে। পরবর্তীতে বিএনপি-নেতৃবৃন্দ কী কী বলেছিলেন, সেগুলোও সকলেই শুনেছেন এবং মনে থাকারই কথা। এবার গতকালের ঘটনাটির কথা। তার আগে শুধু এটুকু স্মরণ করা দরকার, “বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোট গত মঙ্গলবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে। ইসলামী ছাত্রশিবিরও আজ হরতাল ডেকেছে” (প্র.আ,২-৪-১৩)।

উভয় দলের একইদিনে হরতাল আহ্বানের ‘কারণটা অবশ্য ভিন্ন’। শিবির হরতাল ঘোষণা করেছে আগে, সংগঠনের সভাপতিকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে। বিএনপি ডেকেছে পরে, “নেতাকর্মীদের মুক্তি, ‘গণহত্যা’ বন্ধ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ও সরকার-পতনের একদফা দাবিতে”। এতোগুলো ‘দফা’ মিলিয়ে কী করে ‘একদফা’ হয়, সে হিসেবটা মেলানোর চেষ্টা না করাই ভালো। তার চেয়ে বরং পূর্বোল্লিখিত ১১ মার্চের বিএনপি-সভার সঙ্গে ২ এপ্রিলের সভার ‘কাকতালীয়’ সমাপনী মিলটুকুর কথা বলা যাক। “মির্জাৃআলমগীরৃতার বক্তব্য শেষেৃনেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে চলে যান’। কিন্তু এ সময় নেতাকর্মীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি শুরু হয়। বিএনপির কার্যালয়ের পশ্চিম দিকেৃএকটি সাদা মাইক্রোবাসে কে বা কারা আগুন ধরিয়ে দেয়।ৃবিস্ফোরিত হয় কয়েকটি ককটেল।ৃআরো দুটি গাড়িতে আগুন দেয়া হয়।ৃএটিএন নিউজেরৃগাড়িটিতে তখন চালক সোলায়মান ছিলেন।ৃতাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়” (প্রাগুক্ত)। এ খবরটির ওপরেই ‘রাজশাহীতে শিবিরের নৃশংসতার সচিত্র সংবাদে বলা হয়েছে : “পুলিশের ওপর আবারো নারকীয় হামলা // ইট ও হেলমেট দিয়ে (পুলিশ কর্মকর্তার) মাথা থেঁতলে অস্ত্র কেড়ে নিলো শিবির”।

২ এপ্রিল বিএনপি-সমাবেশের ঘটনার পরেই সাংবাদিকরা মির্জা আলমগীরকে প্রশ্ন করেছিলেন : “আপনি শান্তিপূর্ণভাবে চলে যেতে বলার পরও কিভাবে এ ঘটনা ঘটলো’ ৃএমন প্রশ্নের উত্তর এ সময় মির্জা ফখরুল দেননি”। অর্থাৎ ‘আমার বলার কিছু ছিল না’ ভাব করে উত্তরটা এড়িয়ে গিয়েছিলেন। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সীমাহীন স্বাধীনতা ইচ্ছেমতো আছে না-বলার এবং বলারও। ২ এপ্রিল সমাবেশে বিএনপি-নেতা মির্জা আব্বাস বলেছেন :“আমরা দেশ স্বাধীন করেছি ভারতের পরাধীনতার জন্য নয়। ৃআজ সেখান থেকে বসে সিগন্যাল দেয়া হচ্ছে। আর সরকার তাদের কথামতো মানুষ হত্যা করছে” (জনকণ্ঠ, ২ এপ্রিল)। তার কথাগুলো ‘ভাঙা রেকর্ডে পিন আটকে যাওয়া’ পুনরোক্তি বলে মনে হতেই পারে। প্রসঙ্গত কিছু পুরোনো ‘ঐতিহাসিক কথা’ স্মরণ করা যেতে পারে। এইতো মাত্র কয়েক বছর আগে বিএনপি-নেত্রী বেগম জিয়া বলেছিলেন, নির্বাচনে আ.লীগ জিতলে মসজিদ থেকে আজানের বদলে উলুধ্বণি শোনা যাবে এবং বাংলাদেশের এক-দশমাংশ ভারতের দখলে চলে যাবে। বাংলাদেশের মানুষের সৌভাগ্য, অমন কোনো অঘটনই ঘটেনি, অবশ্য অমনটা ঘটতেও পারে না, কারণ ওসব ছিল নিতান্তই ‘মেঠো বক্তৃতা’ বা তার ‘রাজনৈতিক কথা’।

প্রসঙ্গতই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং ইতিহাস-পাঠ থেকে অনেকেই স্মরণ করতে পারবেন, হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর প্রতি ‘ভারতের লেলিয়ে দেয়া কুকুর’ ধরনের অশালীন কথা বলতেও আটকায়নি ‘ঢাকাইয়া বাঙালি’ নাজিমুদ্দিনের। অপরদিকে পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী ‘খাঁটি বাঙালি’ নুরুল আমিন ’৫২-এর মহান মাতৃভাষা আন্দোলনে ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে ছাত্র-জনতাকে হত্যার পর বলেছিলেন, সরকার কি করতে পারে, কম্যুনিস্ট আর হিন্দুরা ভাষার দাবিতে পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছিল। চুয়ান্নর নির্বাচনের আগে কতিপয় পীর-আলেম ফতোয়া দিয়েছিলেন, যুক্তফ্রন্টকে ভোট দিলে ‘বিবি তালাক’ হয়ে যাবে। নির্বাচনে গো-হারার পরে ‘মর্নিং নিউজ’ লিখেছিল, ভারতে চলে যাওয়া হিন্দুরা এসে ভোট দিয়ে যুক্তফ্রন্টকে জিতিয়ে দিয়েছে; ‘ধুতিজ ওয়ার রোমিং ইন ঢাকা স্ট্রিটস’। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বলা হযেছিল, এসব হচ্ছে ভারতের লেলিয়ে দেয়া দুষ্কৃতকারীদের কাজ। ‘নষ্ট ইতিহাস’-এর পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ নেই, নেহাতই মির্জা আব্বাসের সাম্প্রতিক বক্তব্যের সঙ্গে মিলটা লক্ষ করেই বলতে হলো।

তিন. বর্তমানে বাংলাদেশ যে এক অনিবার্য ‘মনুষ্য-সৃষ্ট’ সংকটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে এ-সত্য অস্বীকার করা চলে না। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে নিজে কিছু লেখার চেয়ে বেশ ক’টি পত্রিকা থেকে ২ এপ্রিলের কয়েকটি প্রধান শিরোনাম উল্লেখ করলেই বিষয়টা সহজবোধ্য হবে বলে ধারণা করি। “অর্ধ শতাধিক গাড়িতে আগুন, ভাঙচুর//বিএনপি কার্যালয়ের সামনে তিনটিসহ রাজধানীতেই ১১টি যানে আগুন, শিবিরের ঝটিকা মিছিল থেকে ভাঙচুর, আগুন” (প্র.আ.); “রাজশাহীতে পুলিশের মাথা থেঁতলে অস্ত্র কেড়ে নিলো শিবির” (যুগান্তর); “ছক কষছে নাশকতার// লাশ ফেলার রাজনীতিতে তৎপর জামাত-শিবির” (জনকণ্ঠ); “এবার পুলিশের মাথা থেঁতলে দিলো শিবির” (ভো.কা); “সহিংসতার বর্বর মূর্তি” (আমাদের সময়); “রাজশাহীতে হিংস্ররূপে শিবির” (আমাদের অর্থনীতি); ৬ এপ্রিল ‘হেফাজতে ইসলাম’-এর “লং মার্চে বাধা দিলে দেশ অচল করে দেয়া হবে” (ইনকিলাব); এবং “হেফাজতের লংমার্চে জামাতের নাশকতার পরিকল্পনা রয়েছেÑ তরিকত ফেডারেশন” (সংবাদ)।

এ দেশের জনগণ অপরাজিত এবং অজেয় বলেই প্রতিপন্ন হয়েছে এযাবৎ। তাই একটা প্রশ্ন দিয়েই আজকের লেখা শেষ করতে চাই। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং অতঃপর দুটি সেনা-শাসনের বিরুদ্ধে বিজয়ী যে জনগণ, তারা কি এবার পরাজিত হবে, বিজয়ী হবে চিরকাল পশ্চাৎপদ প্রতিক্রিয়ার শক্তি গোষ্ঠী?

২ এপ্রিল, ২০১৩

এস আর চৌধুরী : কলামিস্ট।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন