সোমবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৩

কোটি জনতার প্রতিনিধি মহাজোটকে কেন বিষ পান করে নীলকণ্ঠ হতে হবে?

মনজুরুল হক
গত কয়েক দিন ধরে টানটান উত্তেজনা শেষে এপ্রিলের ৬ তারিখে সারা বাংলাদেশ জুড়ে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্বরে মঞ্চস্থ হয়ে গেলো বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম ‘মেলড্রামা’! ফেব্রুয়ারি মাসের ৫ তারিখে শাহবাগে যে গণজাগরণ শুরু হয়েছিল তা তাতে বিভিন্ন মহলের গায়ে জ্বালা ধরেছিল। সেই জ্বালায় তারা এতোই জর্জরিত হচ্ছিলেন যে আয়না তর্পণ, বাটি চালান এবং অন্যবিধ চেষ্টায় অবশেষে এটা প্রমাণে সচেষ্ট হলেন যে শাহবাগে যারা গণজাগরণ করছে তারা সবাই নাস্তিক এবং তারা ইসলামের নবী এবং মহান আল্লাহকে অমর্যাদা করেছে। ব্লগার রাজীব হায়দারকে হত্যা করার পর শাহবাগ, শাহবাগের তারুণ্য, সরকার এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যে সব পদক্ষেপ নিলেন তার সবই বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে। যখনই ‘নাস্তিক’ রাজীব হায়দারকে ‘শহীদ’ বলে লাখো মানুষ তার জানাজা পড়লেন, যখনই গণজাগরণ মঞ্চ থেকে যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দাবির সঙ্গে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি উঠলো তখনই ‘কাশিমবাজার কুঠিতে’ বসে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠলেন একালের রাজা রায় দুর্লভ, জগৎ শেঠ এবং ঘষেটি বেগমরা।


ব্লগের মতো একটি সিলেক্টিভ স্পেসে মাত্র শখানেক সমভাবাপন্ন মানুষের মধ্যে একান্তই আলোচনাচ্ছলে যে আলাপ-আলোচনা হতো সেখানে ধর্মদ্রোহিতা নবীদ্রোহিতা পাওয়া গেলো! যা মাত্র শখানেকে সীমাবদ্ধ ছিল তা-ই লাখ লাখ লোকের সামনে বিকৃত আকারে এবং ফটোশপের কারসাজি করে মেলে ধরলো ‘ইনকিলাব’, ‘আমার দেশ’, ‘সংগ্রাম’ এবং ‘দিগন্ত’ টেলিভিশন। ব্যাপারটা এমন দাঁড়ালো যেন আদালতে দাঁড়িয়ে আসামি কীভাবে খুন করেছে তা তাকে বাস্তবে মহড়া করে দেখাতে বলা হচ্ছে! আসামিও জনসমক্ষে আর একজনকে খুন করে দেখিয়ে দিলো সে কীভাবে খুন করেছিল! এখানে প্রথম খুনের জন্য আসামির সাজা হলে দ্বিতীয় খুনের জন্য নয় কেন? এই ‘দ্বিতীয় খুনের’ সকল দায় ভার ওই কয়েকটি পত্রপত্রিকা এবং টিভি চ্যানেলের ওপর বর্তায়। তাদের কাউকেই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলো না, অথচ অখ্যাত চার ব্লগারকে ধরে আনা হলো, রিমান্ডে নেয়া হলো। এবং বাক স্বাধীনতা নামক যে অধ্যায়টি আমাদের সংবিধানে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে কার্যত তা ভূলুণ্ঠিত হলো।

এই অবস্থায় হেফাজতে ইসলাম এর মতো মাত্র দুবছরের একটি কথিত অরাজনৈতিক দল হুমকি দিলো তারা চট্টগ্রাম থেকে লং মার্চ করে ঢাকায় এসে ওই ‘নাস্তিক’ ব্লগারদের বিচার করবে। তারা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলার চেষ্টা করলো যেহেতু তারা কোনো রাজনৈতিক দল নয় তাই তাদের কোনো রাজনৈতিক অভিলাষও নেই। সরকারও তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর ‘ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা’ দিয়ে বুঝলো তারা আসলেই একটি অরাজনৈতিক দল এবং তারা সত্যি সত্যিই মহানবীর অবমাননার বিরুদ্ধেই কেবল সোচ্চার হতে চায়। এই দাবি তো যে কোনো ধর্মভীরু মুসলমানই করতে পারেন। তাতে সমস্যা কী? এবং সেই মতো কথাবার্তাও সরকারের তরফে শোনা গেলো। সরকার তাদের সমাবেশ করার অনুমতিও দিলো। কিন্তু পাশাপাশি শাহবাগের যে আন্দোলন গত দুমাস ধরে চলে আসছে সেই আন্দোলনকারীরা যখন হেফাজতের সমাবেশকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিলো এবং সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ ২৭টি দল হরতাল ডাকল সরকার তাতেও ‘মৌন সায়’ দিলো। এবং যথারীতি মিডিয়া সব ছেড়েছুড়ে এই হরতাল, অবরোধ, সমাবেশ, লংমার্চ নিয়ে দস্তুরমতো মিউটিনি বাধিয়ে দিলো! ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল যেন এবারই বাংলাদেশের ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে। রাতারাতি একটি আঞ্চলিক দল বা গোষ্ঠী ‘জাতীয় হিরো’ বনে গেলো। তারপর আর কী? তারা একবার যখন দেশের ‘মাথার’ ওপর উঠে বসতে পেরেছে তখন তাদের আর নামায় কে? দিগি¦দিগ জ্ঞানশূন্য হয়ে বিএনপি তাদের নৈতিক সমর্থন দিয়ে বসলো। তারা একটিবারও ভেবে দেখলো না হেফাজতের ১৩ দফায় কী আছে? ১৩ দফা মানা হলে যে খোদ বেগম জিয়াই ‘নেই’ হয়ে যাবেন সেটাও তারা আমলে নিলেন না। সেই সঙ্গে সমর্থন জানাল স্বৈরাচার এরশাদ। তার মুখে ইসলাম শব্দটা যতোই বেমানান শোনাক তিনি সেই ইসলামকে ‘রক্ষার’ ব্রত নিয়ে খোলাখুলিই মহাজোটের সঙ্গে ‘বেইমানি’ করলেন। এই সমাবেশ শেষে এখন যদি সবগুলো পক্ষ একটু হিসাব মেলাতে বসেন তাহলে তারা কী পেয়েছেন তা তারাই বলতে পারবেন, তবে সাধারণ মানুষ তাদের পোড় খাওয়া অভিজ্ঞতায় যা দেখেছে এবং যা শুনেছে সেই হিসাব এ দেশের কারো জন্যই সুখকর নয়।

১। হেফাজত এর মতো, পূর্ব পরিচয়হীন আঞ্চলিক একটি দলকে ঠেকানর জন্য, এতো গুরুত্ব দিয়ে, বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম শুক্রবারে হরতাল, পরিবহন ধর্মঘট-কর্মসূচি এবং পাল্টা কর্মসূচির মাধ্যমে একটা জাতীয় ক্রাইসিস সৃষ্টি করা হলো। যার কোনো দরকার ছিল না।

২। হেফাজতের দাবিগুলোর মধ্যে নতুন কিছু নেই। বাংলাদেশের সব ইসলামিক দলগুলোর স্ট্যান্ডার্ড দাবি। এই দাবিগুলোর মধ্যে কিছু রাজনৈতিক, কিছু সামাজিক। বাংলাদেশের গোঁড়া ইসলামপন্থী জনগোষ্ঠীর মধ্যে রাজনৈতিক দাবিগুলো নিয়ে কিছুটা সমর্থন হয়ত থাকতে পারে কিন্তু সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বা নতুন করে তৈরির দাবিগুলো নিয়ে বাংলাদেশের গোঁড়া মুসলমানদের মধ্যেও সামান্যতম সমর্থন নেই। থাকতে পারে না।

৩। সরকার হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতা করে ব্লগারদের গ্রেপ্তার করেছে। মৌলবাদীদের দেয়া লিস্টি ধরে ধরে তাদের ক্রিমিনালের মতো জনসমক্ষে এনে ছবি তুলে অপদস্থ করা হয়েছে সেটা কারোই বোধগম্য নয় কারণ ওদের দাবি মেটানোর পরও ওরা লংমার্চ স্থগিত করেনি সুতরাং এই ধরনের দাবি, লংমার্চ, আরো আসবে। এরই মধ্যে এরা দাবি তুলেছে সকল ব্লগারদের, তাদের আশ্রয়দাতাদের, সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীকেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক। এরপর তারা যদি দাবি তোলে সবাইকে জনসমক্ষে কতল করা হোকÑ তো সরকার কি তখন সবাইকে দেখিয়ে ব্লগারদের কতল করবে ?

৪। এই সমস্যাটি একটি গণতান্ত্রিক দেশের উদাহরণ মেনেই সমাধান করা যেতো। তথ্য মন্ত্রণালয় চাইলে, ব্লগের এডমিন, সিনিয়র ব্লগার, নেট একটিভিস্ট, আলেম-ওলামা, ল’ ইয়ার, আইন প্রণেতাসহ একসঙ্গে বসে এই ইস্যুগুলো নিয়ে একটা আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতো। সাইবার স্পেসে শুধু এটুকুই সমস্যা নয়। আরো সমস্যা আছে। উদাহরণস্বরূপ পর্নোগ্রাফি, বুলিং, শিশুদেরদের ওপর এ্যবিউয, ফ্রড, সোশ্যাল ডিসক্রিমিনেশন। সেই লক্ষ্যে ফ্রিডম অফ স্পিচের সীমা-পরিসীমা নিয়ে একটা ব্যাপক আলাপ-আলোচনা করে সাইবার অ্যাক্ট তৈরি করা যেতো যা দিয়ে সাইবারের এই সমস্যাগুলো মোকাবিলা করা যায়।

৫. ইনকিলাব, সংগ্রাম আমার দেশ পত্রিকা, ব্লগোস্ফিয়ার এর খুব স্বল্প প্রচারিত কিছু ইস্যুকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সামনে এনে ব্লগোস্ফিয়ারের বিরুদ্ধে, সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে যেভাবে তাঁতিয়ে যুদ্ধংদেহী অবস্থায় এনে ফেলেছে তা নিঃসন্দেহে সোস্যাল এনার্কি এবং সরাসরি কম্যুনাল রায়টের অপরাধের মধ্যে পড়বে। এ অবস্থায় তাদেরও আইনের আওতায় আনা জরুরি ছিল। একটা যুক্তি এখানে সয়ংক্রিয়ভাবে উঠে এসেছে, তা হলো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার। অথচ এখন হেফাজতে ইসলাম তাদের ১৩ দফা (প্রয়োজনে নাকি ১০০ দফাও আসতে পারে!) দিয়ে সেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের বুকে খঞ্জর বসিয়ে দিয়েছে। এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মহাজোট সরকার একেবারে ‘সুবোধ বালকের’ মতো তাদের ওই মধ্যযুগীয় দাবি মেনে নেয়া হবে বলে আশ্বস্তও করেছে। দাবি মানা যদিও আরো পরের ব্যাপার, কিন্তু সমাবেশে হেফাজতে ইসলাম যে ক্রুরতা, জিঘাংসা আর ক্ষমতা বদলের হুঙ্কার দিয়েছে তা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কোন তলানিতে নিয়ে ফেলবে সেটা বোধ করি সরকারের নীতিনির্ধারকরা এখনো অনুমান করতে পারছেন না। হেফাজতে ইসলাম বরাবরই বলে আসছে তারা নাকি জামাত বিরোধী, জামাতের কর্মকা- নাকি ইসলাম বিরোধী। এখন যদি প্রশ্ন করা হয়Ñ সামান্য ব্লগাদের বিরুদ্ধে এতো বড় আন্দোলন তাহলে জামাত নিষিদ্ধ করার জন্য হেফাজতে ইসলাম কেন আন্দোলন করছে না? কোনো দিনও কি তারা জামাতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে বলেছে? যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি চেয়ে সারা দেশের মানুষ যখন শাহবাগকে সমর্থন দিয়েছে তখন তারা কি শাহবাগের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছে? ২৮ ফেব্রুয়ারির পর জামাত-শিবিরের ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হলে তারা কি প্রতিবাদ করেছে? জামাতের হাতে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি বিনষ্ট হওয়া, তাদের হত্যা করার বিরোধিতা কি তারা করেছে?

আসলে এই সব রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতা। যুদ্ধাপরাধীর বিচার এবং ফাঁসির রায় থেকে তাদের বাঁচানোর জন্য জামাতের এবং বিএনপির ‘খ্যাপ’ খেলা। তাদের ‘অরাজনৈতিক’ দাবিসমূহ শাপলা চত্বরে এসেই হয়ে গেলো পুরোপুরি রাজনৈতিক। তারা সরাসরি মহাজোট সরকারের পতন চাইলো। সরাসরি শেখ হাসিনার নাম ধরে জঘন্য ভাষায় ভর্ৎসনা করলো। আবার তামাশা করে সেই ভর্ৎসনা ‘প্রত্যাহার’ও করলো! কিন্তু কয়েকদিন পেছনে ফিরে যা দেখা যায় সেটাই কি শাহবাগের প্রতি মহাজোটের বিরাগের কারণ? ইমরান এইচ সরকারের মুখে উচ্চারিত ‘প্রিয় দেশবাসী’ সম্বোধন আর আন্দোলনের মঞ্চ থেকে একাত্তরের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মতো হুকুম জারি করার ঘটনা আওয়ামী লীগের জন্য বরদাশত করা সহজ নয়। কিন্তু ওরা যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাইছে বলে কিছু বলতেও পারছেন না সরকার?

কেউ কেউ বলেনÑ শাহবাগ-আন্দোলন হচ্ছে আওয়ামী লীগের স্রোতের ওপর দূরনিয়ন্ত্রিত নৌকা। আওয়ামী লীগের জলে ভাসমান, আওয়ামী লীগের স্রোতে ধাবমান এবং আওয়ামী লীগের ‘জয়বাংলা’ পাল দৃশ্যমান হলেও, পালে লাগা বাতাস কিন্তু অদৃশ্য! অথচ ঈশান কোণে মেঘ জমতে শুরু করেছে। এক এক করে বিদেশী কূটনীতিকরা কথা বলতে শুরু করেছেন। এরই মধ্যে সরকার কমিটি গঠন করেছেন ইসলামের নবী-বিরোধী নাস্তিকদের চিহ্নিত করতে। অর্থাৎ, ‘নাস্তিক’ ট্যাগধারী ব্লগাররা যাদের হাত ধরে শাহবাগ শুরু তারাও এখন ‘ঘেটু পুত্র’! ইসলামবাদীদের হুঙ্কারে চট্টগ্রামে হার মেনে নিয়ে খাতিরালাপ করার প্রস্তাব দিয়েছেন শাহবাগ-আন্দোলনের নেতৃত্ব। সরকারের তথ্যমন্ত্রী ও মার্ক্সবাদী হাসানুল হক ইনু ‘আসুন আমরা একসঙ্গে ইসলামের হেফাজত করি’ বলে ঈমানি পয়গাম প্রেরণ করেছিলেন ধর্মবাদীদের প্রতি, কিন্তু এক ফুৎকারে সেই পয়গাম ছুড়ে ফেলেছে হেফাজতিরা। এরপর যেটা হতে পারতো সরকার সে পথেও এগোয়নি। তারা যখন সমঝোতার পথ রুদ্ধই করে দিলো তখন তাদের নির্বিঘেœ সমাবেশ করতে দেয়ার অনুমতি দিয়ে যে এক কোটি নবীন ভোটারের ভোটে আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে জিতে এসেছিল সেই পুরো ভোটারদের আস্থা হারালো নিশ্চিতভাবে। যে ব্লগাররা সেই ২০০৮ সাল থেকে ব্লগে, ফেসবুকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুকে তুলে এনে বিপুলভাবে জনমত গড়ে তুলে মহাজোটকে জিতিয়েছিল সেই জনমতের ধারাবাহিকতায়ই এবারের এই শাহবাগের উত্থান। এই সরল সত্যকে ধারণ করতে আবারো ব্যর্থ হলো আওয়ামী লীগ। একটি আঞ্চলিক উদ্রবাদী ‘বিচার যা-ই হোক তাল গাছটি আমার’ চিন্তাধারার দল বা গোষ্ঠীকে গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে ‘সন্তুষ্ট’ করতে গিয়ে লাখ লাখ নতুন প্রজন্মের বিশ্বাস ভঙ্গ করা হলো। এ থেকে কী পেলো আওয়ামী লীগ এবং মহাজোট? ৬ তারিখের উন্মত্ত ‘মব’ সারা দেশের মানুষকে বুঝিয়ে দিলো তারা চাইলেই যে কোনো সময় হাসিনা সরকারকে যা খুশি করাতে বাধ্য করতে পারে। তারা চাইলে সরকার ফেলেও দিতে পারে আবার ‘দয়া পরবশ হয়ে’ কিছুদিন অপেক্ষা করে মোক্ষম সময়ে অন্য একটি গোষ্ঠীর নেপথ্য ইশারায় ফেলে দিতে পারে। এবং ফেলার আগে নাকে খত দেয়ার মতো করে তাদের মধ্যযুগীয় তালেবানি দাবিসমূহও বাস্তবায়ন করিয়ে নিতে পারে।

এই যে মহা শঙ্কার ভেতর বাংলাদেশকে নিয়ে ফেলা হলো এ থেকেই বা কী পেলো আওয়ামী লীগ? তারা কি মনে করেছিল যেহেতু হেফাজতিরা এন্টি জামাত সেহেতু জামাতেক ‘বধ’ করতে ওদের সাহায্য পাওয়া যাবে! ওরা জামাতের বিপক্ষে সরকারের ছায়াসঙ্গী হবে! ওরা লংমার্চ, সমাবেশ করে ঢাকা অচল করে দাবি পেশ, ইচ্ছামতো মনের রাগ ঝাল মিটিয়ে আপামর মুক্তচিন্তার মানুষদের কুৎসিত কদাকার গালাগাল করতে পারার আনন্দে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোটের বাক্স ভরে দেবে?

এটা যে কতো বড় ভুল তা দেখার জন্য শুধুমাত্র নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলে ক্ষতি ছিল না, ক্ষতিটি হচ্ছে তার আগেই বাংলাদেশের সংবিধানের ওপর, সমাজের ওপর শকুনের শ্যেন দৃষ্টি আর ঘোর অমানিশা নেমে আসতে পারে। আর তা ঘটলে তারও দায়-দায়িত্ব পড়বে ওই আওয়ামী লীগেরই ঘাড়ে। এ পরিস্থিতিতে মহাজোট নৌকা বাঁচাতে কথিত নাস্তিকদের বিসর্জন তো দিচ্ছেই সেই সঙ্গে আরো কী কী বিসর্জন দিতে হবে তারও তালিকা ধরিয়ে দেয়া হয়েছে।

এরই মধ্যে ব্লগারদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ আন্তর্জাতিক মহলেও শুরু হয়েছে। অর্থাৎ বহির্বিশ্বের ভাবমূর্তি আরো এক দফা চোট খাওয়ার অবস্থায় চলে গেছে। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সংবাদÑ ‘বাংলাদেশে সম্প্রতি ধর্ম অবমাননার অভিযোগে চার ব্লগার গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন দি ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্ট (আইএফজে)। তারা অবিলম্বে গ্রেপ্তার চার ব্লগারকে মুক্তি দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। এই গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে বাংলাদেশের অন্যান্য সাংবাদিকও মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি সোচ্চার পক্ষগুলোর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে অবিলম্বে ওই চার যুবকের মুক্তির জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আইএফজে। বিবৃতিতে একই সঙ্গে বাংলাদেশের সংবিধান কর্তৃক সুরক্ষিত মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার সমুন্নত রাখতে দেশের সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের অনুভূতিকে আমলে নেয়ার জন্যও সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।’ আইএফজে বিশ্বের ১৩১টি দেশের ছয় লক্ষাধিক সাংবাদিকের প্রতিনিধিত্বকারী আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সংগঠন। আওয়ামী লীগ কি ‘নীলকণ্ঠ’ হয়েছে? কেন তাকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার পরও সব বিষ পান করে নীলকণ্ঠ হতে হবে? কেন একাত্তরে লাখো শহীদের রক্তে রাঙা স্বাধীন সেক্যুলার বাংলাদেশকে হাজার বছর পেছনে নিয়ে অন্ধকারে নিপতিত হওয়ার আবদার মানতে হবে?

৭ এপ্রিল, ২০১৩

মনজুরুল হক : কলাম লেখক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন