হাসান ফেরদৌস
এস এন এম আবদিকে অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। কলকাতার নামজাদা সাংবাদিক,
যদিও অভিনেত্রী শ্রীলা মজুমদারের স্বামী হিসেবেই তাঁর অধিক পরিচিতি। একসময়
ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়ার কলকাতা ব্যুরোপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন
করেছেন। এম জে আকবরের সানডে ম্যাগাজিনে তাঁর কিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের
জন্য প্রশংসিতও হয়েছিলেন। তবে সবচেয়ে বেশি যে কারণে লোকে তাঁর নাম মনে
রেখেছে, তা হলো তাঁর বিরুদ্ধে বছর তিনেক আগে কলকাতায় এক যুবতীকে ধর্ষণের
অভিযোগ। দুই মাস জেল খাটার পর শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত সমঝোতার মাধ্যমে সে
অভিযোগ থেকে তিনি রেহাই পান।
তো এই ভদ্রলোক নানা বিষয়ে পণ্ডিত বলে পরিচিত হলেও বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর ওপর তাঁর বিশেষ জ্ঞান বা জানাশোনা আছে, তা কখনো শুনিনি। বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়েও তিনি খুব একটা জানেন বা জানার চেষ্টা করেছেন, তাঁর লেখায় সে কথার প্রমাণ দেখিনি। এই আবদি সাহেব হঠাৎ এক মস্ত তত্ত্ব আবিষ্কার করে বসেছেন। সম্প্রতি ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ঢাকা সফরে এসেছিলেন, তাঁর সঙ্গে আউটলুক পত্রিকার হয়ে তিনিও ঢাকায় তশরিফ রাখেন। ফিরে গিয়ে ভদ্রলোক সেই পত্রিকায় এক নিবন্ধে দাবি করেছেন, জামায়াতে ইসলামীর যত অপরাধই থাকুক, শুধু ধর্মীয় কারণে তারা কখনো কোনো হিন্দুকে হত্যা করে না। ‘এটা তাদের ব্যাপারে বলার মতো সবচেয়ে ভালো কথা।’
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হিন্দু যে মরে না তা নয়, কিন্তু আবদি সাহেবের হিসাব অনুসারে, সেসব আক্রমণের মূল কারণ রাজনৈতিক। তিনি লিখেছেন, ভারতীয় ও পশ্চিমা পত্রপত্রিকায় এই দলটির ব্যাপারে নানা কুৎসা রটনা করা হয়ে থাকে; তার কারণ, সত্যের বদলে গালগপ্প করাই তাদের আসল উদ্দেশ্য। ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক অশান্তির প্রতিবেদনে তারা (অর্থাৎ ভারতীয় ও পশ্চিমা তথ্যমাধ্যম) জামায়াতে ইসলামীকে রাত-দিন এক দানব হিসেবে দেখাতেই ব্যস্ত।’ আবদি সাহেব আমাদের জানিয়েছেন, জামায়াতের এই যে ছবি, তা মোটেই ঠিক নয়। দলটিতে কিছু শ্মশ্রুমণ্ডিত নেতা-কর্মী আছেন বটে, কিন্তু তাঁরা কেউই ধর্মের নামে কাটাকাটি করেন না।
বলা বাহুল্য, আবদি সাহেবের সে নিবন্ধ ঢাকার জামায়াতপন্থী পত্রপত্রিকার দৃষ্টি এড়ায়নি। তাদের কেউ কেউ সে লেখার অনুবাদ কিছুটা মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রথম পাতায় যথারীতি ছেপেছে। এদের কেউ ভারতকে দুই চক্ষে দেখতে পারে না, কিন্তু সে দেশের পত্রিকায় কে একজন দুকলম লিখে সার্টিফিকেট দিল, আর অমনি তা ফলাও করে ছাপা হয়ে গেল সেসব পত্রিকার প্রথম পাতায়।
আবদি সাহেব সম্ভবত ভুলে গেছেন বা জেনেও না জানার ভান করছেন যে ১৯৭১-এ ঘাতক পাকিস্তানি সেনা প্রশাসনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল ধর্মীয় শুদ্ধতা রক্ষা এবং বাঙালিকে পাক্কা মুসলমান বানানো। সে মকসদ পূরণের জন্য সেনা হাইকমান্ড থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, হিন্দু খতম করো। সে সময় নিজেদের পরিচয় প্রমাণের জন্য মুসলমানদের পরনের বস্ত্র উন্মুক্ত করে দেখাতে হতো। তাদের বাড়ি যাতে হিন্দু বাড়ি ভেবে আক্রমণ না করা হয়, সে জন্য সদর দরজায় বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকত ‘মুসলমানের বাড়ি’। আত্মরক্ষার জন্যই অসহায় গৃহস্থকে এই পথ ধরতে হয়েছিল, কিন্তু তা থেকে বুঝতে ভুল হয় না পাকিস্তানি ঘাতকদের আক্রমণের লক্ষ্য কে ছিল। বাঙালি মুসলমানকেও তারা আক্রমণ করেছিল, তার এক কারণ ছিল পাকিস্তানি সেনা কমান্ডের চোখে বাঙালিরা যথার্থ মুসলমান হিসেবে বিবেচিত হতো না। এ কথা আইয়ুব খান থেকে রাও ফরমান আলী, সবাই কোনো না কোনোভাবে বোঝাতে চেয়েছেন। অন্যদিকে পাকিস্তানি সেনা কমান্ডাররা তাদের ‘ধর্মপ্রাণ’ সেনাদের এই কথা বোঝাতে চেয়েছে, হিন্দু হত্যায় কোনো পাপ নেই, উল্টো পুণ্য রয়েছে।
১৯৭১-এ বাঙালি বধ অভিযানে পাকিস্তানিদের সার্বক্ষণিক সহচর ছিল জামায়াতে ইসলামী। এই দলের অধিকাংশ নেতা-কর্মীদল পাকিস্তানের সৃষ্টি রাজাকার বাহিনীর নেতা-কর্মী হিসেবে তাদের সব তৎপরতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল। পাকিস্তানিদের হাতে সংঘটিত প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের রক্তে তাদের হাতও রাঙা। এসব রাজাকারের অপরাধের বিবরণ এখন নানাভাবে নথিবদ্ধ হয়েছে। ঢাকায় বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে অভিযুক্ত একাত্তরের যে ঘাতক-দালালদের বিচার চলছে, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, তাদের বাড়িঘর আক্রমণ ও সম্পত্তি দখল সেসব অভিযোগের অন্যতম।
আবদি সাহেব সেসব অভিযোগের বিবরণ না পড়ে, ঢাকায় দুই দিনের জন্য বেড়াতে এসে ধরে নিলেন, ভারতের বিজেপির তুলনায় বাংলাদেশের জামায়াত একেবারে ধোয়া তুলসী পাতা। তিনি লিখেছেন, ধর্মের কারণে হিন্দু আক্রমণের কোনো ঘটনা বাংলাদেশে বহু বছর ঘটেনি। ধর্মের কারণে তারা হিন্দু আক্রমণ করেছে, জামায়াতিদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ঢাকায় ভারতীয় কূটনীতিক বা হিন্দু নেতারা কেউই নাকি করেননি। আবদির যুক্তি, হিন্দুদের ওপর যে আক্রমণ হয়েছে তার আসল কারণ তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থক। বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা সে কারণেই তাদের ওপর চড়াও হয়েছে। তাঁর কথা থেকে মনে হয়, যেহেতু পুরো ব্যাপারটাই রাজনৈতিক, অতএব এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, পশ্চিম বাংলায় তৃণমূল ও সিপিএমের মধ্যে সংঘর্ষে যারা মারা যায়, তাদের কেউ কেউ মুসলমান। তো, এমন ঘটনা সেখানে হরহামেশাই ঘটছে, তা নিয়ে মাথা গরম করার কী আছে?
পশ্চিম বাংলায় তৃণমূল-সিপিএম বিবাদে কত সংখ্যালঘু মুসলমান মারা গেছে, তার হিসাব আমার জানা নেই। কিন্তু পত্রিকার খবর থেকে এতটুকু জেনেছি, গত দু-তিন সপ্তাহে বাংলাদেশের কমপক্ষে ১৬টি জেলায় হিন্দু মন্দির আক্রান্ত হয়েছে, হিন্দু গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, হিন্দু রমণী লাঞ্ছিত হয়েছে। আবদি সাহেব সম্ভবত বাংলাদেশের পত্রিকা পড়েন না। ঠিক আছে, বাংলাদেশের পত্রপত্রিকার কথা ছেড়ে দিই। তাঁর নিবন্ধ লেখার আগে আবদি সাহেব অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য বিজ্ঞপ্তি পড়ে দেখলেও সে খবর জানতে পারতেন। লন্ডনভিত্তিক এই মানবাধিকার সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, সারা দেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর আক্রমণ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে ৪০টির বেশি মন্দির ভস্মীভূত হয়েছে। সংস্থাটির একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, ‘বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।’ জামায়াত ও বিএনপি এই হামলার পেছনে, সে কথা উল্লেখ করে সংস্থাটি অভিযোগ করেছে, দেশের সরকার সংখ্যালঘু হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আবদির যুক্তি অনুসারে, হিন্দুরা যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও থাকে, তারা জামায়াতের আক্রমণের ‘টার্গেট’ নয়; বড়জোর রাজনৈতিক সহিংসতার ‘কোলেটারাল ড্যামেজ’ বা আনুষঙ্গিক ক্ষতির শিকার। আর তারা যদি আক্রান্ত হয়েই থাকে, সে জন্য দোষ তো তাদেরই। সবাই জানে হিন্দুরা আওয়ামী লীগের সমর্থক। সে কারণে জামায়াত-বিএনপি যদি তাদের গোস্যা ঢেলে হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়, তাতে অবাক হওয়ার কী আছে? এ ধরনের গোয়েবলসীয় যুক্তি একাত্তরে পাকিস্তানিরাও দেখাতে সাহস পায়নি। আবদির কাছে আমার জিজ্ঞাসা, যে জামায়াতকে তিনি সফেদ-সাদা বলে হোলসেল সার্টিফিকেট দিলেন, তারা অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে হিন্দু মন্দির আক্রমণ করে কেন? ধর্মীয় ছাড়া সে মন্দিরের আর কোনো পরিচয় আছে কি? আবদি সাহেব যত চেষ্টাই করুন না কেন, রাজনৈতিক নামের রঙিন জামা পরালে জামায়াতিদের অপরাধের মাত্রার কোনো হেরফের হবে না। যাদের বাড়িঘর জ্বলল, যাদের কন্যা লাঞ্ছিত হলো, রাজনৈতিক বলায় তাদের নির্যাতন ও লাঞ্ছনার মাত্রাও কোনো অংশে হ্রাস পায় না।
সত্যি কথা হলো, জামায়াত ও তার রাজনৈতিক বন্ধুরা, যারা চলতি তাণ্ডবের পেছনে, হিন্দু ঘায়েলের ট্রেনিংটি তারা পেয়েছে পাকিস্তানি ওস্তাদদের কাছ থেকে। একাত্তরের ঘটনাবলি তদন্তের জন্য পাকিস্তান সরকার যে হামুদুর রহমান কমিশন গঠন করে, তাতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে একজন পাকিস্তানি সেনা অফিসার জানান, জেনারেল নিয়াজি তাকে জিজ্ঞেস করেন, সে কত হিন্দু হত্যা করেছে। ‘মে মাসে আমাদের লিখিতভাবে নির্দেশ দেওয়া হয় হিন্দু হত্যা করো।’ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তার রাজাকার সহযোগীরা সানন্দে সে নির্দেশ পালন করেছে।
একাত্তরে হিন্দু হত্যায় জামায়াতে ইসলামী কোনো অপরাধ দেখেনি, এখনো দেখে না। একাত্তরে ধর্মের নামে গণহত্যা হয়েছিল। ঘাতক-দালালদের বিচারের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে জামায়াতে ইসলামী ও তার বন্ধুরা যে তাণ্ডব শুরু করেছে, তা একাত্তরেরই পুনরাবৃত্তি। সেই জামায়াতের পক্ষে সাফাই গেয়ে এস এন এম আবদি নিজেকে তাদের দোসর হিসেবেই প্রমাণ করলেন।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
প্রথম আলো, তারিখ: ১৮-০৩-২০১৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন