লন্ডন: ব্রিটেনের মাইনাস তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস আবহাওয়ার তুষার আবৃত রাস্তায়ও অবিরাম হাঁটছে “হিমু বাহিনী”। ঢাকার শাহবাগে চেতনার যে স্ফূরণ ঘটেছে, সেই চেতনাকে বুকে ধারণ করে বিলেতের ট্রাডিশনাল আবহাওয়াও গতিরোধ করতে পারছে না বাঙালির দ্বিতীয় প্রজন্মের এই সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিমু বাহিনীর।
চেতনার অগ্নিস্ফূলিঙ্গের কাছে মাইনাস ডিগ্রির তীব্র ঠাণ্ডাও যেন একাত্তরের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মতো পরাজিত এই তারুণ্যের কাছে!
চেতনার অগ্নিস্ফূলিঙ্গের কাছে মাইনাস ডিগ্রির তীব্র ঠাণ্ডাও যেন একাত্তরের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মতো পরাজিত এই তারুণ্যের কাছে!
ব্রিটেনে বসবাসরত একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল নায়কসহ বহির্বিশ্বে আশ্রয় নেওয়া যুদ্ধাপরাধীদের দেশে ফেরৎ পাঠানোর দাবিতে ‘ওয়াকিং ফর জাস্টিস’ কর্মসূচির এই অভিযাত্রীরা ছুটে চলছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে!
ব্রিটেন যেন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের ‘সেইফ হ্যাভেন’ না হয়, এ আশা নিয়েই হিমু বাহিনী যাচ্ছে ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে। ‘সভ্য দুনিয়ার মুরুব্বি’খ্যাত ব্রিটেন যুদ্ধাপরাধী নরঘাতকদের ‘সেইফ হ্যাভেন’ এটি তো সভ্যতার সঙ্গে বেমানান। হুমায়ুনের হিমু বাহিনী পদযাত্রার মাধ্যমে ব্রিটেনবাসীকে এটিই বোঝাতে চাইছে।
অবিরাম হাঁটা পথে শহরে শহরে থামছেন এই আলোর পথের অভিযাত্রীরা। লিফলেট হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন ব্রিটেনের মূলধারার জনগণসহ ব্রিটিশ-বাঙালিদের। ব্রিটিশ জনগণকে তারা হুঁশিয়ার করছে দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে ‘যুদ্ধাপরাধী’ নামে যে কলঙ্ক বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশ, একাত্তরের গণহত্যার নায়কদের ‘সেইফ হ্যাভেন’ হয়ে ব্রিটেনও যেন সেই কলঙ্কে কলঙ্কিত না হয়!
যুক্তরাজ্য গণজাগরণ মঞ্চের সহযোগিতায় ২০ মার্চ সকাল ৮টায় বহির্বিশ্বে বাঙালির প্রথম শহীদ মিনার ম্যানচেস্টারের ওল্ডহাম থেকে শুরু করা ‘ওয়াকিং ফর জাস্টিস’ কর্মসূচির এই পদযাত্রী দল হাঁটার পথে থামছে শহরে শহরে। স্থানীয় বাংলাদেশিরা নিজ নিজ শহরে বিপুলভাবে অভিনন্দিত করছেন বাঙালির দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের এই রণসৈনিকদের।
সমাবেশও হচ্ছে কোনো কোনো শহরে। সমাবেশগুলোতে গগদবিদারী স্লোগান উঠছে- ‘আর কোনো দাবি নাই, যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই’। ‘ব্রিটেনে আশ্রয় নেওয়া গণহত্যার নায়কদের বাংলাদেশে ফেরৎ পাঠাও’।
ওল্ডহাম থেকে যাত্রা শুরু করে স্টোক অন ট্রেন্ট, ট্রনওয়ার্থ, রাগবি, বার্মিংহাম, মিল্টন কিংস হয়ে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ‘ওয়াকিং ফর জাস্টিস’ নায়কেরা এই মুহূর্তে অবস্থান করছেন নর্দাম্পটন শহরে।
গণজাগরণ মঞ্চের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি বিশ্বের ৪০টি দেশে সমাবেশের অংশ হিসেবে নর্দাম্পটনে তারা পালন করছেন ‘যুদ্ধাপরাধী বিরোধী’ সমাবেশ।
মোবাইল ফোন, টুইটার ও ফেইসবুকে অভিযাত্রার প্রতিমুহূর্তে তারা আপগ্রেড করছেন বাংলানিউজকে। বাংলানিউজের প্রথম স্টোরি ‘ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর অফিস অভিমুখে হুমায়ুনের হিমু’ বিপুলভাবে উৎসাহিত করছে তারুণ্যদীপ্ত এই অভিযাত্রীদের!
কর্মসূচির সমন্বয়ক ‘হিমু’ চরিত্রের ফজলুল কবির বলেন, “বাংলানিউজের ‘ওয়াকিং ফর জাস্টিস’ কর্মসূচির নিউজ আমাদের দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। বাঙালির দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ শাহবাগ জাগরণের সব খবর তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের পৌঁছে দিয়েছে বাংলানিউজ। শাহবাগের সমর্থনে ব্রিটেনে আমাদের কর্মসূচিগুলোও এখন সারা বিশ্বে পৌঁছে দিচ্ছে বাংলানিউজ।
আমরা মনে করছি, বাঙালির দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে বাংলানিউজও আমাদের রণসঙ্গী। ব্রিটেনে বেড়ে ওঠা তরুণ ব্রিটিশ বাঙালি সাজ্জাদুল আজিজ মালিক বলেন, “পথে পথে বাঙালির উষ্ণ ভালোবাসা মাইনাস ডিগ্রির তীব্র ঠাণ্ডাকে আমাদের কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না। আমরা নিশ্চিত চূড়ান্ত লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাবোই। পথে পথে ব্রিটিশ জনগণও ব্যাপক আগ্রহী হয়ে উঠছেন আমাদের কর্মসূচিতে। বাঙালির ৪১ বছরের পর্বতপ্রমাণ কলঙ্ক ব্রিটেনকেও কলুষিত করুক, এটি আমরাও চাই না।এদিকে, নিজ নিজ স্থানীয় এমপি-র মাধ্যমে এ বিষয়ে সোচ্চার হচ্ছেন তারা; এমনই আশ্বাস দিচ্ছেন ব্রিটিশ জনগণ আমাদের।”
ব্রিটেনে বেড়ে ওঠা এই তরুণ আরও জানালেন, “জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলো’ পড়েই আমি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলনে শরিক হতে আগ্রহী হয়েছি।”
শনিবার মধ্য ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে পৌঁছালে গণজাগরণ মঞ্চের স্থানীয় তরুণ-তরুণীরা ব্যাপকভাবে অভিনন্দিত করেন ‘ওয়াকিং ফর জাস্টিস’ কর্মীদের। বহির্বিশ্বে প্রথম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন স্থান স্মলহিথ পার্কে টিমকে স্বাগত জানান স্থানীয় গণজাগরণ মঞ্চ সংগঠক মশুদ আহমেদ, মিসবাউর রহমান, সৈয়দ এলাহি হক সেলু ও সোহেল আহমেদ প্রমুখ।
প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় তুষার আবৃত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্মলহিথ পার্কে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলন অব্যাহত রাখার দৃপ্ত শপথ গ্রহণ শেষে স্থানীয় একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত হয় সমাবেশ।
সমাবেশে বার্মিংহামের স্থানীয় বাংলাদেশি কমিউনিটির পক্ষ থেকে ব্যাপকভাবে অভিনন্দিত করা হয় ‘ওয়াকিং ফর জাস্টিস’-এর হিমু বাহিনীকে।
এর পর হিমু বাহিনী বার্মিংহাম থেকে রওয়ানা দিয়ে মিল্টনকিংস হয়ে নর্দাম্পটনে এসে পৌঁছান রোববার। সোমবার তারা পৌঁছাবেন লন্ডন থেকে ৪০ মাইল দূরবর্তী লুটন শহরে। লুটনে ‘ওয়াকিং ফর জাস্টিস’ টিমকে ব্যাপক সংবর্ধনা দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
মঙ্গলবার সকাল ১১টায় সেন্ট্রেল লন্ডনের রিজেন্ট পার্কে এসে পৌঁছবেন ‘আলোর পথের অভিযাত্রী’ হিমু বাহিনী। গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোগে সেখানে অনুষ্ঠিত হবে সমাবেশ।
সমাবেশ থেকে দুপুর ১টায় সমর্থকদের নিয়ে টিম পৌঁছাবে ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। স্মারকলিপির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুনের কাছে আবেদন করা হবে ব্রিটেনে আশ্রয় নেওয়া যুদ্ধাপরাধীদের বাংলাদেশে ফেরৎ পাঠানোর।
৩০০ মাইল পায়ে হাঁটা কর্মসূচির সমাপ্তি ঘটবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে।
কালজয়ী কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের ‘আজ রবিবার’ নাটকে ‘হিমু’ চরিত্রে অভিনয়কারী ফজলুল কবির তুহিন ও ব্রিটেনে বেড়ে ওঠা তরুণ ব্রিটিশ-বাংলাদেশি সাজ্জাদুল আজিজ মালিকের নেতৃত্বে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর অফিস অভিমুখি এই পদযাত্রায় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির দুই সাহসী নারী সংগঠক স্মৃতি আজাদ ও মঞ্জুলিকা জামালীও অবিরাম হাঁটছেন তুষার আবৃত ব্রিটেনের রাস্তায়।
যুক্তরাজ্য গণজাগরণ মঞ্চের সহযোগিতায় ২০ মার্চ সকাল ৮টায় বহির্বিশ্বে বাঙালির প্রথম শহীদ মিনার ম্যানচেস্টারের ওল্ডহাম থেকে শুরু করা ‘ওয়াকিং ফর জাস্টিস’ কর্মসূচির এই পদযাত্রায় অন্যান্যের মধ্যে রয়েছেন প্রবীণ সাংবাদিক, বঙ্গবন্ধুর এক সময়ের প্রেস সেক্রেটারি আমিনুল হক বাদশাহ, ব্রিটেনে বসবাসরত তরুণ সাংবাদিক আ স ম মাসুম, সাংবাদিক জুয়েল রাজ ও স্বপন চৌধুরী প্রমুখ।
পথে পথে অনেকেই তাদের সঙ্গী হচ্ছেন। কয়েক মাইল হেঁটে কেউ কেউ চলে যাচ্ছেন নিজ কাজে, আবার নতুন সঙ্গী পাচ্ছেন ‘ওয়াকিং ফর জাস্টিস’ কর্মীরা। এভাবেই চলছে অবিরাম হাঁটা কর্মসূচি।
উল্লেখ্য, গণজাগরণ মঞ্চ, যুক্তরাজ্য প্রতিমুহূর্তে তত্ত্বাবধান করছে ওয়াকিং ফর জাস্টিস কর্মসূচি। মূল সহযোগী হিসেবে গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোগেই বিভিন্ন শহরে স্বাগত জানানো হচ্ছে পায়ে হাঁটা টিমকে।
গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র অজন্তা দেব রায় বাংলানিউজকে বলেন, “অহিংস আন্দোলন ‘শাহবাগের গণজাগরণ’ আজ বিশ্ব্যবাপী সমাদৃত। ওয়াকিং ফর জাস্টিসের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর অফিস অভিমুখি এই পদযাত্রাও সেই আন্দোলনের একটি অংশ।”
তিনি বলেন, “বিশ্ববাসীকে আমরা জানান দিতে চাই- একাত্তরে অস্ত্র হাতে নিয়ে দেশ স্বাধীন করলেও অহিংস পন্থায়তেও বাঙালি দাবি আদায় করতে জানে! শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের ন্যায্য দাবি আদায়রত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের শান্তিকামী মানুষের প্রেরণা হয়ে উঠেছে। আমরা এই আলোর বার্তা ছড়িয়ে দিতে চাই বিশ্বব্যাপী, সবখানে সবখানে...!!”
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন