সোমবার, ১৮ মার্চ, ২০১৩

একটি বক্তৃতা ॥ মিথ্যাচার আর হুমকি

মুহম্মদ শফিকুর রহমান
বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট (যদিও দু’টি ছাড়া বাকি ১৬টিই ওয়ান-ম্যান ওয়ান-প্যাড পার্টি) নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বুধবার তাঁর নয়া পল্টন দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশে ১৩ মিনিটের একটি বক্তৃতা দেন, যার পুরোটাই মিথ্যাচারে ভরা এবং রয়েছে বেশকিছু হুমকি। তিনি তাঁর স্বভাবজাত অভ্যাস থেকে বেরোতে পারেননি। টিভি চ্যানেলে তাঁর সরাসরি কণ্ঠ এবং পরদিন বৃহস্পতিবারের দৈনিক পত্রিকা থেকে উদ্ধার করা মিথ্যাচার আর হুমকিগুলো হলো : মিথ্যাচার-১) আওয়ামী লীগ হিন্দুদের বাড়ি-ঘরে হামলা করেছে। ২) আমরা হিন্দুদের পাশে আছি। থাকব, ৩) সাম্প্রতিক সহিংসতা ‘গণহত্যা’ ৪) গণহত্যার জন্য প্রধানমন্ত্রী দায়ী এবং ৫) আমরাও যুদ্ধাপরাধের বিচার চাই। হুমকিগুলো হলো ১) ‘মঞ্চ-ফঞ্চ’ বানানো বন্ধ করুন ২) মঞ্চ-ফঞ্চ বানিয়ে বাঁচতে পারবেন না। ৩) ক্ষমতা থেকে টেনে নামানো হবে, ৪) ‘গণহত্যার’ বিচারে ট্রাইব্যুনাল করা হবে এবং ৫) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে সবার বিচার করা হবে।
সবচেয়ে জঘন্য কথাটি বলেছেন- সরকার একদিকে আমাদের সভা ভাঙছেন বোমা- গুলি ছুড়ে, অপরদিকে ‘নাস্তিকদের’ লালন করছেন (?) এ কথার প্রথম অংশ মিথ্যাচার, দ্বিতীয় অংশ সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক। প্রথম অংশটি স্বভাবজাত এবং প্রতিনিয়তই তা করে চলেছেন। দ্বিতীয় অংশটি রীতিমতো ভীতিকর একজন মানুষের সাংস্কৃতিক দৈন্যের স্তর কত নিচে নামলে কাউকে ‘নাস্তিক’ বলে তার জীবন হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারেন সম্ভবত বেগম জিয়াই এর প্রকৃত উদাহরণ। তবে তার দলটি মূলত সাম্প্রদায়িক এবং চরম সাম্প্রদায়িক দল জামায়াত-শিবিরকে নিয়ে জোট বেঁধে নিজেরাও আরও সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠেছেন। বেগম জিয়া ও তাঁর দল এবং জোট যেহেতু স্বাভাবিক পথে ক্ষমতায় যাওয়ার রাস্তাই খঁজে পাচ্ছে না তখন তৃতীয় অরাজনৈতিক-অনৈতিক-অগণতান্ত্রিক শক্তিকে ক্ষমতায় আসার পথ দেখানোর জন্যই সহিংস পথ বেছে নিয়েছেন। চরম সহিংস জামায়াত শিবিরের সন্ত্রাসী কর্মকা-কে সমর্থন-সহযোগিতা দিচ্ছেন। তৃতীয় শক্তি এলে আর যাই হোক, আওয়ামী লীগ তো ক্ষমতাচ্যুত হবে এবং তখন লাইনের তৃতীয় ভাইজানরা এলে এমনও হতে পারে যে ক্ষমতার উদ্দিষ্টও দিতে পারে এবং যুদ্ধাপরাধীদেরও কারাগার থেকে ছাড়িয়ে এনে কোলে বসিয়ে দিতে পারে। কিন্তু এসবই এক অবান্তর চিন্তা। তৃতীয় শক্তি বলে যাদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয় সেই সেনাবাহিনী ক্ষমতার রাজনীতির ব্যাপারে নিরপেক্ষ বলে আমার বিশ্বাস এবং তারাও জাতির সচেতন অংশ হিসেবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক শাস্তি হোক শাস্তি কার্যকর হোক তা চায়। কেনইবা তারা আসবে? অতীত অভিজ্ঞতা বলে এ ধরনের এ্যাকশনে কতিপয় জেনারেল বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ক্ষমতার সাধ পায়, সাধারণ সৈনিকরা তো কেবল ব্যবহৃত হয়েছে অতীতের প্রতিটি মিলিটারি এ্যাকশনে, ক্ষমতার সাধ কি তারা তা জানে না। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগ হয়ে, প্রথমে পাকিস্তান হবার অল্পদিনের মাথায় তৃতীয় শক্তির বন্ধুরা ক্ষমতা দখল করে দেশটাকে তছনছ করে দেয় এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মাথায় বাঙালীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর এবং সর্বশেষ মাত্র ৪ বছর আগেও সাধারণ সৈনিকরা দেখেছে। কেনইবা তারা জামায়াত-শিবিরের মতো ঘৃণিত শক্তি ও তাদের শরিকদের কথায় পড়বে? নিজের ভালটা শিশুও বোঝে, সৈনিকরা বুঝবে না তা কি হয়?

এবার আসছি তার মিথ্যা কথাগুলো আলোচনায়। ‘আওয়ামী লীগে অনেক রাজাকার’- তাঁর বক্তব্য নির্জলা মিথ্যা। ঐতিহাসিক জ্ঞান থাকলে তিনি জানতেন বা মোটামুটি একটা লেভেল পড়াশোনা থাকলে দেখতে পেতেন আওয়ামী লীগের সমালোচনার অনেক কিছু আছে। কিন্তু এ দলে রাজাকার আছে বা ছিল এমনটি কেউ বলতে পারবে না। রাজাকারী ভাবনা এবং সাম্প্রদায়িকতা একই কথা। আওয়ামী লীগের জন্মই হয়েছিল (১৯৪৯ সালের ২৩ জুন) সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই-এর লক্ষ্য নিয়ে এবং সেই থেকে দলটি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছে, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধেও পাকি এবং তাদের দোসর সাম্প্রদায়িক জামায়াত শিবির ও তাদের ঘাতক বাহিনী রাজাকার আলবদর আল শামসদের পরাভূত করেই আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে, বাঙালীর জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার হাজার বছরের স্বপ্নসাধ বাস্তবে রূপ দিয়েছিল। খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগে রাজাকার হিসেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নামোচ্চারণ করেছেন গত মঙ্গলবারের বক্তৃতায়। এর জবাব মহীউদ্দীন খান আলমগীর দেবেন। ইতোমধ্যে দিয়েছেনও আমি বলব ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাম্প্রতিক জামায়াতী সহিংসতার মুখে যা যা করেছেন কিংবা মঙ্গলবার বিএনপি কার্যালয়ে যেভাবে তল্লাশি করিয়েছেন, তা নিয়ে রাজাকার এবং তাদের সহযোগীরা সোচ্চার হবেন, স্বাভাবিক কিন্তু তাঁর দলের কারও কারও কিছু মন্তব্য দুঃখজনক বটে। তাছাড়া যারা তাঁকে রাজাকার বলেন তাদের এটুকু বলব একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সব মানুষ ভারতে যেতে বা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেনিÑ কেউ ভীতির কারণে কেউবা সুযোগ করে নিতে পারেনি তা-ই দেশাভ্যন্তরে চাকরি-বাকরি করেছে তাদের সবাইকে রাজাকার বলা ঠিক নয়। তাদের সংখ্যা মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে বেশি। তাছাড়া নিজের দিকেও তাকানো উচিত। আর যিনি বলছেন আওয়ামী লীগে রাজাকার আছে প্রথমত কথাটা মিথ্যা দ্বিতীয়ত বরং তার দল বিএনপিই গঠিত হয়েছে ভাসানী ন্যাপের রাজাকার-হাফ রাজাকার, মুসলিম লীগের রাজাকার এবং মুসলিম লীগ-জামায়াত-নেজামে ইসলাম পার্টির রাজাকারদের বাগিয়ে তাদের দিয়ে। ‘আওয়ামী লীগ হিন্দুদের বাড়ি-ঘরে হামলা করেছে’Ñ এটিও চরম মিথ্যাচার। রবং জন্মলগ্ন থেকে আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক- ধর্মনিরপেক্ষ নীতিই চর্চা হয়ে এসেছে। ১৯৪৯ থেকে এ পর্যন্ত যতবার এদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা হয়েছে প্রত্যেকবারই আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলোই ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষরাও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও সমমনাদের পাশাপাশি যুদ্ধ করেছে। এমনকি ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বঙ্গবন্ধুই প্রথম ‘পূর্ব বাংলা রুখিয়া দাঁড়াও’ ব্যানার নিয়ে ঢাকার রাজপথে মিছিল নিয়ে দাঙ্গা প্রতিরোধ করেন পরদিন দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক অবজারভার ও দৈনিক সংবাদসহ বিভিন্ন কাগজে ‘পূর্ববাংলা রুখিয়া দাঁড়াও’ এই শিরোনামে অভিন্ন সম্পাদকীয় ছাপা হয়েছিল, দাঙ্গা বন্ধ হয়েছিল। নিকট অতীত ১৯৯৩ সালে ভারতের উগ্র হিন্দুদের দ্বারা ‘বাবরী মসজিদ ভাঙ্গা’ হলে বিএনপির সুহৃদ সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী ভয়েস অব আমেরিকা রেডিওতে খবর পাঠান ‘বাবরী মসজিদ ভাঙ্গায় বাংলাদেশের হিন্দুরা ঢাকায় মিষ্টি খেয়ে উল্লাস করেছে,’ ব্যস আর যায় কোথায় ভারতের উগ্র হিন্দুদের মতই ঢাকায় উগ্র মুসলমানরা হিন্দু মন্দির ভাঙ্গা শুরু করে। সেদিনও আওয়ামী লীগই প্রথম রাজপথে নামে এবং ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতি মিছিল বের করে। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হলো রাতের প্রথম প্রহর ৪টার দিকে লেখক গবেষক- ইতিহাসবিদ প্রফেসর ড. মুনতাসীর মামুন আমাকে টেলিফোনে ঘুম থেকে জাগিয়ে সকাল ৭টার দিকে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে যাওয়ার জন্য বলেন। গিয়ে দেখলাম আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পাশাপাশি জননী সাহসিকা বেগম সুফিয়া কামাল প্রফেসর কবীর চৌধুরী, প্রফেসর খান সরোয়ার মুরশিদ, সৈয়দ শামসুল হক, ফয়েজ আহমেদ, মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবির এবং আরও অনেকে উপস্থিত হয়েছেন। আমরা পুরনো ঢাকায় মিছিল করে প্রেসক্লাবে এসে তৎকালীন গেস্ট রুম বর্তমান নিচতলার খাবার ঘর। যৌথ বিবৃতি দিয়েছিলাম যে কারণে তৎকালীন বিএনপি জামায়াতপন্থী ক্লাব কর্তৃপক্ষ ঐ কক্ষের প্রধান দরজা বন্ধ করে ছিটকিরি লাগিয়ে দেয় Guests are not allowed এঁবংঃং ধৎব হড়ঃ ধষষড়বিফ সারাদেশে ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এমনি মিছিল হয়েছিল সেদিন বিএনপির কাউকে দাঙ্গা প্রতিরোধে দেখা যায়নি। বরং তারা মনে মনে হাসছিল। এর অর্থ দাঁড়ায় বিএনপিপন্থীরা দাঙ্গা লাগায় আর আওয়ামী লীগ ও সমমনারা দাঙ্গা প্রতিরোধ করে। বিএনপি নেত্রী বলেছেন, তারা হিন্দুদের পাশে আছেন এবং থাকবেন। এ আরেকটি মিথ্যা কথা। ২০০১-এর নির্র্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোট বেঁধে ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন নির্যাতন চালায় আওয়ামী লীগ, হিন্দু- বৌদ্ধ-খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর ওপর। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়ার এবং নৌকার পক্ষে কাজ করার কর্মী সমর্থকদের হত্যা, হাত কেটে দেয়া, বাড়ি-ঘর-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুট। দখল এবং নারী -নির্যাতনের ঘটনা ঘটায়, এমন কি হিন্দু বিধবা মহিলারাও বিএনপি-জামায়াতী সন্ত্রাসী এবং সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের নির্যাতনের শিকার হন- মাত্র তো ১১ বছর আগের ঘটনা, এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন ম্যাডাম? তিনি বলেছেন, তারাও যুদ্ধাপরাধের বিচার চান, তবে তা হতে হবে স্বচ্ছ এবং আন্তর্জাতিক মানের। ফ্রান্স, টকিও, কম্বোডিয়া, বসনিয়ার যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন ও কার্যক্রম কত স্বচ্ছ এবং সকল পক্ষের অধিকার রক্ষা করে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন, শুধু এইটুকুই বলব এখানে যুদ্ধাপরাধীরা আইনজীবী নিয়োগ, সাক্ষী নিয়োগ। প্রতিপক্ষের সাক্ষীকে সওয়াল-জওয়াবে করা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন এমনকি উচ্চ আদালতে আপীল করার সুযোগ পর্যন্ত পাচ্ছেন, যা পৃথিবীর কোথাও নেই। তিনি সাম্প্রতিক জামায়াত-শিবিরের সহিংসতা, মানুষ হত্যা, পুলিশ হত্যা, মানুষের গাড়ি-বাড়ি ভাঙচুর, এ সবকে ‘গণহত্যা’ বলছেন। গত শনিবারের লেখায় আমি বলেছি ‘গণহত্যা’ বা ইংরেজী genocide শব্দের অর্থ কি? অর্থ হলোÑ “ব্যাপক হত্যা দ্বারা বা জীবন ধারণের পক্ষে সম্পূর্ণ প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি করে কোন জাতি বা সম্প্রদায়ের বিলোপ সাধন (deliberate extraimnation of a race or community by mass murder or by imposing conditions that make survival impossible.) এর মানে গণহত্যা বা মবহড়পরফব হয়েছে ১৯৭১ সালে এবং তা করেছে পাকি হানাদার মিলিটারি জান্তা এবং তাদের সহযোগী জামায়াত ছাত্রসংঘ (ছাত্র শিবির), মুসলিম লীগ ও অন্যান্য সাম্প্রদায়িক শক্তি, যাদের নিয়ে বেগম খালেদা জিয়া এখন ঘর করছেন। তাঁর তো বোঝার কথা নয়। রাজাকাররা তাঁকে বুঝিয়েছে এটাকে ‘গণহত্যা’ বলে চালানো গেলে ১৯৭১ সালের ‘গণহত্যাকে’ ভুলিয়ে দেয়া যাবে। অতএব, তিনি বলে দিয়েছেন? মনে হয় মানুষ সব অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত বা বোকার স্বর্গে বাস করে (?) বিএনপির বুদ্ধিজীবী মাহফুজ উল্লাহ ফরহাদ মাযহার আসিফ নজরুল, নুরুল কবির, পিয়াস করিম, আমেনা মহসিন এবং হালের কিছু সাবেক ছাত্রলীগ নামধারী টিভি আঁতেল এ প্রশ্নে কি বলেন জানা দরকার।

বেগম জিয়া অন্যায়ভাবে শাহবাগ প্রজন্ম চত্বর তথা শাহবাগসহ দেশব্যাপী গণজাগরণ মঞ্চকে তুচ্ছ- তাচ্ছিল্য ভরে কথা বলেছেন। শব্দ ব্যবহার করেছেন ‘মঞ্চ-ফঞ্চ’। এর মানে তার রাজনীতির অন্তরাত্মায় তরুণ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা এমন আঘাত হেনেছেন। যে রাগে-দুঃখে যা মুখে আসছে বলে দিচ্ছেন। বাচ্চাগুলো এমন দুষ্ট যে, ‘জয় বাংলা’ সেøাগান বাংলার গ্রাম-গঞ্জ শহর-বন্দর সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়ে এমন এক আবহ সৃষ্টি করেছে এখন আর ‘জয় বাংলা’র বাইরে গিয়ে রাজনীতি করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেগম জিয়ার প্রয়াত স্বামী ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মিলিটারি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দম্ভভরে বলে ছিলেন I will make politics difficult for the politicians (রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতি করা কঠিন করে তুলব আমি)” আর গণজাগরণ মঞ্চের তরুণরা যা করেছে তা- হলো,“ Joy BANGLA has made politics difficult for begum Khaleda Zia and her friends’’ তিনি গণজাগরণ মঞ্চের ছেলেদের ‘নাস্তিক’ বলেছেন। এমন ফতোয়া তিনি দিতে পারেন কি-না বা আমাদের পবিত্র ধর্ম ইসলাম তাকে এই ক্ষমতা দিয়েছে কি-না, আমি সেদিকে যাব না, এ ব্যাপারে ফাইনাল কথা বলার মতো ধর্মীয় জ্ঞান আমার নেই ও বলে আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু একটা ব্যাপার জানি তা হলো ‘আপনি আচরি ধর্ম অপরে শেখাও’। যে মানুষ ধর্ম কর্ম করে না, যে মানুষ ধর্মের সত্যিকার বাণী জনসমক্ষে তুলে ধরার জ্ঞান অধিকার রাখেন না , এ অবস্থায় তিনি যখন ফতোয়া দেন তখন তা ধর্মপ্রাণ ইসলামে বিশ্বাসী মানুষকে আঘাত করে, বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। না-জেনে বা খোঁজ খবর না-নিয়ে প্রজন্ম চত্বরের ছেলে-মেয়েদের ‘নাস্তিক’ বলা তা-ই খালেদা জিয়ার একটি গর্হিত কাজ হয়েছে। একাত্তরে পাকি হানাদার মিলিটারি জান্তা রণাঙ্গনে আমাদের বলত ‘দুষ্কৃতকারী’ এবং আমরা না-কি ‘হিন্দু’ হয়ে গেছি। খালেদা জিয়াও আজ নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধাদের নাস্তিক বলে জনরোষের শিকার বানাতে চাচ্ছেন- এটা তার দুরভিসন্ধি ছাড়া আর কিছুই নয়। খালেদা জিয়া প্রজন্ম চত্বরের সদস্যদের নাস্তিক বলছেন অথচ ওরা বারবার বলেছে ওদের লড়াই যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে- পবিত্র ইসলাম বা ধর্মের বিরুদ্ধে তাদের কোন অবস্থান নেই। তবু তিনি বলছেন।

তবে হ্যাঁ, কোন একটা স্পর্শকাতর গুজব সমাজে ছড়িয়ে দিতে পারলে কিছু সময়ের জন্য হলেও মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায় (তবে সবসময় নয়)। এই যেমন ফাঁসির দ-প্রাপ্ত দেইল্লা রাজাকার ওরফে মাওলানা সাঈদীর ছবি নাকি চাঁদে দেখা গেছে? এই গুজবকে কেন্দ্র করে বগুড়াসহ দেশের কয়েকটি স্থানে কি আত্মঘাতী কা-টাই না ঘটে গেল। টিভি চ্যানেলে দেখলাম বগুড়ায় বোরখাপরা মহিলারা বিশাল বিশাল সব দা, বাঁশ, দা তলোয়ার উঁচিয়ে বিক্ষোভ করছে ‘দেইল্লা রাজাকারের মুক্তি’ দিতে হবে। থানা আক্রান্ত হয়েছে পুলিশের প্রাণহানি ঘটেছে আবার পুলিশের গুলিতে গ্রামের সহজ সরল ধর্মপ্রাণ অথচ বিভ্রান্ত মানুষেরও জীবনহানি ঘটেছে। অথচ বিষয়টি যে কত বড় জ্বালিয়াতি, ওলামাদের মতে সরাসরি ‘বেদাআত।’

বিয়ষটি হাস্যকরও বটে। এবং এ নিয়ে অনেক মুখরোচক গল্পও শোনা গেছে, যা ছাপার অক্ষরে পরিবেশন করা যায় না। তাই করলাম না। তবে যে সব সহজ সরল ধর্মপ্রাণ নারী-পুরুষ বিভ্রান্ত হয়ে রাস্তায় নেমে লঙ্কাকা- ঘটালেন তাদের ব্যাপারে একটা কথা বলতে চাইÑ কোনদিকে দৌড় দেয়ার আগে জানা দরকার কোথায় দৌড়াচ্ছেন, কেন দৌড়াচ্ছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। চিলে কান নিয়ে গেছে বলে দৌড়ের আগে কানে হাত দিয়ে দেখা দরকার কানটা আছে না গ্যাছে? একটি সেল- ফোনের বিজ্ঞাপন খুব মজার- (কথা পরিষ্কারভাবে শোনা সংক্রান্ত) এক লোক ভাজা-সিমের বিচিতে কামড় দিলে দাঁতে ব্যথা পান, ভদ্রলোক ব্যথায় উচ্চারণ করেন ‘দাঁত ভেঙ্গে গেছেরে...।’ লোকজন শুনলেন ‘ বাঁধ ভেঙ্গে গেছে।’ আর থামায় কে? সবাই বাঁধের দিকে ছুটছে তো ছুটছে। এই ইমেজের আরেকটি বিজ্ঞাপন হলো এক গৃহিণী তার কর্তাকে বললেন বাজার থেকে বড় দেখে একটা ‘হাঁস’ আনতে, ভদ্রলোক বাজার থেকে বড় মোটা দেখে একটা ‘বাঁশ’ নিয়ে এলেন, দেখে গৃহিণী আগুন। এগুলো হলো শ্রবণ -বিভ্রান্তি? আর ‘দেইল্লা রাজাকারের মুখ চাঁদে দেখা গেছে’ এটা হলো পরিকল্পিতভাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে মানুষকে রাজপথে নামিয়ে যদি দেইল্লা রাজকারের ফাঁসির হুকুমটা বাতিল করা যায়, এই প্রচেষ্টা। প্রচেষ্টা না বলে ষড়যন্ত্র বলাই ভাল, ‘কারণ’ এর স্রষ্টা ষড়যন্ত্রের হোতা জামায়াত-শিবির।

ম্যাডাম খালেদা জিয়া যখন অভিযোগ করছেন প্রজন্ম চত্বরের ছেলেমেয়েরা ‘নাস্তিক’ তখন মাগরিবের আজান হচ্ছিল এবং তিনি তার বক্তৃতা বন্ধ বা স্থগিত না করে বক্তৃতা শেষ করেন আজানের মধ্যেই। আজানও শেষ তাঁর বক্তৃতাও শেষ হলো। বেগম খালেদা জিয়া বললেনÑ পুলিশ বোমা-গুলি ছুড়ে ১৮ দলীয় জোটের মঙ্গলবারের নয়াপল্টনের জনসমাবেশ প- করে দেয়। এটি এখটি অসত্য তথ্য। মানুষ যা নিজ চোখে দেখেছে তাকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন মিথ্যা তো বটেই, বরং যিনি বলছেন তাঁর ব্যক্তিগত সততা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে পারে। জনগণ টিভি চ্যানেলের সুবাদে দেখেছে ঐদিন পুলিশ জনসমাবেশস্থলে বা বিএনপি কার্যালয়ের আশপাশে কোথাও আসেনি বা অবস্থান নেয়নি। পুলিশের অবস্থান ছিল পূর্বে ফকিরাপুল মোড় ও পশ্চিমে নাইটেঙ্গেল মোড়। তা-ও সিকিউরিটি রিজনে। সমাবেশ চলছে, অনেক নেতা বক্তৃতা করলেন সর্বশেষ বক্তা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব) তাঁরও বক্তৃতা প্রায় শেষ এমন সময় নাইটেঙ্গেল মোড়ে পুলিশের সামনে প্রথম বোমাটির বিস্ফোরণের শব্দের সাথে সাথেই মিজা ফখরুল পরদিন বুধবার হরতাল ডেকে দিলেন। এরপর অবশ্য বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। তবে মির্জা ফখরুলের হরতাল ডাকার গ্রাউন্ডটি এতো শিশুসুলভ ছিল যে, টিভি দর্শকদের বোঝার বাকি রইল না সব কিছু পূর্বপরিকল্পিত ছিল। অর্থাৎ বোমা ফাটিয়ে হরতালের ঘোষণা হবে।

বেগম জিয়া পুলিশের প্রতি হুমকি দিয়েছেনÑ জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় আপনাদের বেতন-ভাতা হয় (কথাটি মূলত এরশাদবিরোধী অন্দোলনে শেখ হাসিনা বলতেন) অথচ সেই জনগণের বিরুদ্ধে যাচ্ছেন অপনারা। ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে আপনাদেরও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। এটা শুনে আমার এক ভাগ্নি সরকারী কলেজের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর রোকেয়া মন্তব্য করলেন পুলিশের মতো এমপি- বিরোধী দলীয় নেতাও জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় বেতন-ভাতা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। বিরোধীদলীয় নেতা-তো পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদায় বা ছায়া সরকারপ্রধানের মর্যাদায় সব পান, তবুও সংসদে যান না কেন? রবং তিনি হরতাল ডাকেন আর জামায়াত- শিবিরসহ তাঁর জোটের কর্মীরা সেই জনগণেরই গাড়ি- বাড়ি দোকানপাঠ ভাঙচুর করে, আগুন দিয়ে জ্বালায়, জনগণের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা, বোমা, হত্যার ঘটনা ঘটায় আবার পুলিশের প্রতিরোধে নিরীহ জনগণের প্রাণ যায়? এসব প্রশ্নতো বিরোধীদলীয় নেতাকে করা যায়?

বস্তুত খালেদা জিয়া যখন অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন তখন নিজের দিকে তাকান না বা সচেতনভাবেই ভুলে যান। তিনি ভুলে গেছেন ২০০৪ সালের ১ মার্চ তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে তৎকালীন পুলিশ আওয়ামী লীগ অফিসে কি করেছিল? টিয়ার গ্যাস ছুড়তে ছুড়তে আওয়ামী লীগ অফিসে বেধড়ক লাঠি পেটা করেছিল, গ্রেফতার করেছিল। ভাঙচুর করেছিল। সেদিনও দেড় শতাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, গত মঙ্গলবার বিএনপি অফিস থেকেও দেড় শতাধিক গ্রফতার করা হয়। তবে একটু পার্থক্য আছে ২০০৪-এর আওয়ামী লীগ অফিসের মতো বিএনপি অফিসে নেতাকর্মীদের পেটানো হয়নি। কক্ষ ভেঙ্গে তাদের বের করা হয়েছিল মাত্র। আরেকটি কথা পাপিয়া বা নিলুফার মনির তৃতীয় শ্রেণীর নারীদের এমপি বানিয়ে ভুল করেছেন বলে মনে করি। এরাও তার ইমেজ নষ্ট করছে।
সর্বশেষ একটা কথা বলতে চাই, খালেদা জিয়া বলেছেন ক্ষমতায় গেলে প্রধানমন্ত্রীসহ সবাইকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন। বিচার করবেন। কিন্তু ক্ষমতায় গেলো তো?...

ঢাকা-১৪ মার্চ ২০১৩
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
 
সৌজন্যেঃ জনকণ্ঠ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন