রবিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৩

নিউইয়র্কে জামায়াতের দেশবিরোধী গভীর ষড়যন্ত্র

মাহফুজুর রহমান, নিউইয়র্ক থেকে ॥ যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের বিচারের রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাইরে সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে গিয়ে একটি মহল বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে প্রকারান্তরে কাজ করছে। আমেরিকায় বসবাসকারী জামায়াত-শিবিরের সাবেক নেতাকর্মীরা বিভিন্ন নামে সংগঠন গড়ে এই কাজটি করছেন অনায়াসে। আর এতে নেপথ্যে ইন্ধন যোগাচ্ছে আমেরিকান-পাকিস্তানী বিভিন্ন গোষ্ঠী ও চ্যারিটি সংগঠন। এ ক্ষেত্রে তারা বেছে নিয়েছেন মসজিদগুলোকে। আর পাকিস্তানীদের উদ্যোগে ও নিয়ন্ত্রিত ইসলামী সার্কল অব নর্থ আমেরিকা (ইকনা) নামের সংগঠনটি এবং এর বাংলাদেশী কিছু সদস্য এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি তৎপর বলে জানা গেছে।
সাঈদীর মৃত্যুদ- রায় ঘোষণার পর বাংলাদেশে জামায়াতী তা-বেরর পর থেকে তাদের উদ্যোগ যেন আরও বেড়ে যায়। নিউইয়র্কসহ অন্যান্য স্টেটের বাংলাদেশী ও পাকিস্তানী নিয়ন্ত্রিত মসজিদগুলোতে বাংলাদেশে মুসলিম নিধন হচ্ছে এবং ’৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদের ইসলামী স্কলার হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের ফাঁসি দেয়া হচ্ছে বলে প্রচার করা হচ্ছে। অনেক বাংলাদেশী মসজিদে জুমার খুতবায় বেতনভোগী ইমামরাও একইভাবে বর্তমান সরকারকে ইসলামবিরোধী অ্যাখ্যায়িত করে দেশে মুসলমান হত্যার গল্প ফেঁদে বয়ান করছেন। অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব জামায়াতপন্থী ইমামরা সাধারণ প্রবাসীদের বাধার মুখে তাদের এই একপেশে খুতবা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
এদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় ঘোষণার পর পরই ইকনার কোন কোন সদস্য এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মসজিদগুলো বিশেষভাবে এর বিরোধিতায় লিপ্ত হয়ে ব্যাপকভাবে প্রচারে নেমেছে। ইকনার বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত সাবেক সভাপতি ও একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের অন্যতম নায়ক এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী আশরাফ উজ্জামান খান বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে ইসলাম বিরোধিতার নামে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এসব কর্মকা-ে মূল ইন্ধন যোগাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা আমলে নেয়ার পর পরই নিজেকে পর্দার আড়ালে নিয়ে গেলেও যুদ্ধাপরাধীদের মামলার রায় ঘোষণা হবার পর থেকে আবারও মাঠে নেমেছেন পাকিস্তানী পাসপোর্টে এ দেশে এসে নাগরিকত্ব গ্রহণকারী আশরাফ উজ্জামান খান। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ভারতের বিহারে জন্মগ্রহণকারী ইকনার সক্রিয় সদস্য ইমাম হাফিজ জাকির এবং গায়নীজ বংশোদ্ভূত ইকনার সদস্য ইমাম আজিম খান। জ্যামাইকার হিলসাইড ও অন্যান্য মসজিদে এরা জুমার খুতবায় প্রচার করছেন যে ‘বাংলাদেশ বার্নিং এ্যান্ড মুসলিম স্কলারস আল কিলড বাই দ্য গবর্মেন্ট।’ শুধু মসজিদে মসজিদে এই অপপ্রচার সীমাবদ্ধ নয়, ইকনার ম্যাগাজিন ‘মেসেজ’-এ বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে নিয়মিত অপপ্রচার হচ্ছে। এই মেসেজ ম্যাগাজিনের বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত সম্পাদক বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করে কি করছেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরুর পর জামায়াতের ছদ্মবেশী সংগঠন মুসলিম উম্মাহ অব নর্থ আমেরিকা (মুনা) যেভাবে প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করে আসছিল এই মুহূর্তে তাদের সেভাবে মাঠে কেন দেখা যাচ্ছে নাÑ তা খতিয়ে দেখতে গিয়ে জানা গেছে মুনা তাদের নাম ব্যবহার না করে বিভিন্ন নামে অসংখ্য সংগঠনের ব্যানারে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত-বিচারাধীন জামায়াত নেতাদের মুক্তির দাবিতে সভা-সমাবেশ ও লবিং করছে। এক্ষেত্রে মুনা এবার তাদের মহিলা সদস্যদের অধিকহারে বিভিন্ন কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করছে, যা চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশেী-আমেরিকান কোয়ালিশনসহ দেশের মতো এখানেও বিভিন্ন পেশাজীবীর ব্যানারে সংগঠন রেজিস্ট্রেশন করে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর তথাকথিত আন্দোলনে সক্রিয় হয়েছে মুনা। ইকনার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত মুনা বাংলাদেশী কমিউনিটিতে ব্যাপকভাবে জামায়াতের রাজনীতি প্রচারে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে গত কয়েক মাসে ব্যাপক বিজ্ঞাপন প্রচার করে যাচ্ছেÑ আর নেপথ্যে রয়েছে মুসলিম উম্মাহর প্রচার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। জাতিসংঘের সামনেসহ নিউইয়র্কের বিভিন্ন বরাতে এবং আমেরিকার অন্যান্য শহরেও নেপথ্যে থেকে মুনা আয়োজন করছে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির দাবিতে এবং সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগারমূলক প্রতিবাদ সমাবেশ। এসব সমাবেশে বিপুল সংখ্যক মহিলা ও শিশুর উপস্থিতি ঘটিয়ে তা সফল করার জন্য ব্যয় করা হচ্ছে প্রচুর অর্থ।
একই সঙ্গে বিভিন্ন মুসলিম দেশের এখানকার তাদের মতোই সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং ইকনার কোন কোন সদস্যের সহায়তায় বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম বিপর্যয়ের মুখে বলে তাদের বোঝানো হচ্ছে। যে ভাষায় তা বলা হচ্ছে তা শুনলে মনে হবে বাংলাদেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘিষ্ঠ এবং অন্যান্য দেশে যেমন সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলমানরা নির্যাতিত হচ্ছে তেমনই ঘটছে বাংলাদেশে। কিন্তু তারা কখনই বলছে না যে প্রায় ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে জামায়াত মাত্র ৩ পার্সেন্ট ভোট পায়। আর অন্যদিকে ৯৫ ভাগের বেশি মুসলমানের ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সময়ে সময়ে সরকার গঠন করে। এদিকে বহির্বিশ্বে দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে জামায়াত-শিবির ও তাদের দোসররা বিভিন্ন মিডিয়ায় ভুল ও বিকৃত তথ্য সরবরাহ করে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে গিয়ে প্রকারান্তরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে বলে মন্তব্য করেছেন ফোরাম ফর সাউথ এশিয়ান পীস এ্যান্ড স্ট্যাবিলিটির নির্বাহী প্রধান আমেরিকান-ইন্ডিয়ান সৈয়দ সাদাত হোসেন। ভারতের মুম্বাইতে জন্মগ্রহণকারী এবং নিউইয়র্কে ইংরেজী ইন্ডিপেন্ডেন্ট ভয়েসের প্রকাশক-সম্পাদক সৈয়দ সাদাত হোসেন বলেন, জামায়াত ও তাদের দোসররা নিউইয়র্কসহ আমেরিকায় যেভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারণা করছে তাতে বাংলাদেশের ইমেজকে ক্ষতিগ্রস্ত করার প্রয়াসে রয়েছে তারা। ১৯৭১ সালে যে চেতনা নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই চেতনার বিরুদ্ধে গিয়ে জামায়াত এখানে পাকিস্তানীদের সঙ্গে মিলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জঘন্য মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়েছে। তাদের কার্যকলাপে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আমরা ফোরাম ফর সাউথ এশিয়ান পীস এ্যান্ড স্ট্যাবিলিটি ভারতীয় উপমহাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা কামনা করি এবং সেই সঙ্গে জঙ্গীবাদী কার্যক্রমের বিরুদ্ধেও রয়েছে আমাদের অবস্থান। সেই অবস্থান থেকেই আমরা দক্ষিণ এশিয়ার অভিবাসী যারা এখানে আছি তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে তার প্রতিবাদ জানাতে শীঘ্রই নিউইয়র্কের জ্যামাইকার ইকনা সদর দফতরের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে বাংলাদেশের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করব।
এদিকে প্রবাসে বিভিন্ন মিডিয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে গিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনসত্তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে কোন কোন মিডিয়াÑ এই অভিযোগ করেছেন জাতিসংঘ বাংলাদেশ মিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি প্রেস মোহাম্মদ মামুন অর রশিদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিজিবির পোশাকে যদি ভিন্ন কোন দেশের সৈন্য দায়িত্ব পালন করে তাহলে তো বাংলাদেশ এখন আর কোন সার্বভৌম-স্বাধীন দেশ না? বর্তমানে এমন ঘটনা ঘটলে সেই খবরটা শুধু কোন কমিউনিটি নিউজ পেপারই পেল, নিউইয়র্ক টাইমস বা ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল এই তথ্য পেল না কেন? মামুন ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, পত্রিকাগুলো তাদের সম্পাদকীয় নীতির ভিত্তিতে সরকারের সমালোচনা করতেই পারে কিন্তু সেটা করতে গিয়ে সীমা অতিক্রম করে দেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কিভাবে লেখে? আর তাদের সেই তথ্য যদি সঠিকই হয় তাহলে তারা সেটা মূলধারার মিডিয়ার কাছে তুলে ধরে না কেন?
মুক্তিযোদ্ধা যুব কমান্ড যুক্তরাষ্ট্রের সভাপতি তরুণ রাজনীতিবিদ ও সংগঠক জাকারিয়া চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যেই নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করুক না কেন- তারা বাংলাদেশের সিংহভাগ মুসলমান ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের ভোট পেয়ে সেই যোগ্যতা অর্জন করে। কিন্তু ’৭১-এর পরাজিত শক্তি জামায়াত তাদের যুদ্ধাপরাধী নেতাদের বাঁচাতে বাংলাদেশকে ধ্বংস করে দিতে হলেও পিছপা হবে নাÑ তার প্রমাণ তারা দেশের মতো প্রবাসেও দেখাচ্ছে। জাকারিয়া জামায়াত-শিবির, ইকনা-মুনার বাংলাদেশবিরোধী প্রচারের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক সব বাংলাদেশীকে রুখে দাঁড়াবার আহ্বান জানান।
এদিকে ক্রমবর্ধমান হারে বাংলাদেশ ও সরকারবিরোধী প্রচারের বিরুদ্ধে দূতাবাস ও কনস্যুলেটগুলোর কোন ভূমিকা না দেখে হতাশ হচ্ছেন সচেতন প্রবাসীরা। তাঁরা বলছেন, জামায়াতী অপপ্রচারের বিরুদ্ধে কূটনৈতিকরা কমিউনিটির সঙ্গে মতবিনিময় করে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরে দেশে জামায়াতের তাণ্ডব- কোরান পুড়িয়ে ফেলা, মসজিদে আগুন দেয়া, মন্দির ভাঙ্গাসহ বিভিন্ন অপকর্মের বিস্তারিত জানালে সরলপ্রাণ বাংলাদেশী মুসলমানরা জামায়াতী অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আরও সক্রিয় হয়ে প্রতিবাদ করবেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন