সোমবার, ১৮ মার্চ, ২০১৩

জনমনে শঙ্কা ॥ শক্তি পরীক্ষার রাজনীতিতে মুখোমুখি দ'পক্ষই

জনকণ্ঠ ॥ বিশেষ প্রতিনিধি ॥ কঠিন সময় পার করছে দেশের রাজনীতি। আজ সোমবার হরতাল শুরুর প্রথম দিনেই রাজধানীতে সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে মুখোমুখি হচ্ছে সরকার ও বিরোধী দল। সংলাপের মাধ্যমে সঙ্কট সমাধান নয়, বিরোধী দলের দেশ অচল করার হুমকি, আর ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার প্রস্তুতিতে ক্রমেই উত্তপ্ত ও জটিল আকার ধারণ করছে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি। সঙ্কট সমাধানের পরিবর্তে সরকার ও বিরোধী দলের এই মুখোমুখি অবস্থানে অনিবার্য সংঘাত-সংঘর্ষের আশঙ্কায় দেশবাসীর মনে নতুন করে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে।
আজ সোমবার থেকে টানা দু’দিনের হরতাল ডেকেছে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। হরতাল সফল করতে প্রকাশ্য সাংগঠনিক শক্তি প্রদর্শনের পরিবর্তে চিরচেনা রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী রবিবার রাতে রাজধানীসহ দেশের বেশকিছু স্থানে যানবাহনে আগুন, বোমাবাজির মাধ্যমে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে তারা। বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক কর্মসূচীর নামে ধ্বংসাত্মক ও সহিংস কর্মসূচী মোকাবেলায় বসে নেই সরকার পক্ষও। সারাদেশে রাজনৈতিকভাবে বিরোধী দল মোকাবেলায় ব্যাপক প্রস্তুতির পাশাপাশি আজ রাজধানীতে জনসভার নামে বড় ধরনের শো-ডাউন করার সকল প্রস্তুতি শেষ করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলটির নেতাদের দাবি, জনসভায় আসা মিছিল ও মানুষের ঢলে ভেসে যাবে বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতাল।

সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে এই মুখোমুখি অবস্থানে অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকেই যাচ্ছে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি। কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছে দেশের জনগণ। বিদেশী রাষ্ট্র, দাতা দেশ-গোষ্ঠী ছাড়াও দেশের সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ পর্যন্ত বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপের কথা বললেও তা অনেকটাই ‘অরণ্যরোদনে’ পরিণত হয়েছে। সরকারী দলের তরফে সরাসরি প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসতে অনাপত্তি জানালেও খালেদা জিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থান সংলাপের ভাগ্য শুরুতেই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

শীর্ষ ব্যবসায়ীসহ দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ পর্যন্ত তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও জীবন রক্ষার খাতিরে হরতালের বিকল্প অন্য কোন কর্মসূচী দেয়ার জন্য বিরোধী দলের প্রতি আবেদন জানালেও জামায়াতকে সঙ্গী করে বিএনপি ‘হরতাল’ নামক ক্ষতিকর অস্ত্রকেই সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে। তাদের টার্গেট লাগাতার হরতাল দিয়ে দেশের সকল কিছুকে অচল ও অর্থনীতিকে পঙ্গু করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা। আর এ টার্গেট পূরণে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তির পাশাপাশি উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে সারাদেশে সহিংস তান্ডব চালিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে বিরোধী দল।

বিরোধী দলের এমন পরিকল্পনা মোকাবেলায় বসে নেই সরকারী দল আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে সারাদেশেই বিএনপি-জামায়াতের সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়েছে তারা। সরকারী দলের নেতাদের দাবি, আজ রাজধানীর সোহ্্রাওয়ার্দী উদ্যানে মানুষের যে ঢল নামবে, তাতে হরতাল আহ্বানকারী বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের খুঁজেও পাওয়া যাবে না। আর আজকের জনসভা থেকেই বিরোধী দলের সকল চক্রান্ত রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার দিকনির্দেশনা দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলীয় প্রধানের দিকনির্দেশনা অনুযায়ীই সারাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের দল ও তাদের দোসরদের মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুত গ্রহণ করা হবে।

সংলাপ প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রবিবার বলেন, সংলাপের নামে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে নেয়া কিংবা তাদের বিভ্রান্ত করা যাবে না। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জায়গায় সরকারকে আসতেই হবে। তিনি এও দাবি করেন, সরকারের পায়ের নিচে মাটি সরে গেছে। তারা ভীত হয়ে পড়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে আগামীতে আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না, সে জন্যই বিরোধী দল দমনের পথ বেছে নিয়েছে সরকার।

বিএনপির এমন অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুব-উল-আলম হানিফ তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, সংলাপের মাধ্যমে যে কোন সমস্যার সমাধান সম্ভব। কিন্তু খালেদা জিয়া সংলাপের পথ পরিহার করে সংঘাতের পথ বেছে নিয়েছেন। উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে তিনি দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। তাঁর সংলাপ নাকচ করার মতো অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।

তিনি আরও বলেন, সংলাপ পরিহার করে জামায়াত-শিবিরকে উস্কে দিয়ে খালেদা জিয়া দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না এটা বুঝতে পেরেই বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া এই ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নিয়েছেন। জনগণের প্রতি আস্থাহীনতা ও রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার কারণেই বিএনপি এমন আচরণ করছে। তবে দেশের জনগণ তাদের সেই ষড়যন্ত্র সফল হতে দেবে না। জনগণের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে তা-ব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

সরকারী সূত্রে জানা গেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করবে না সরকার। তবে বর্তমান সংবিধানের আওতায় কীভাবে আগামী নির্বাচন আরও গ্রহণযোগ্য করা যায়, তা নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত সরকার। সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারক জনকণ্ঠকে ক্ষমতাসীনদের এ মনোভাবের কথা জানিয়ে বলেন, সংবিধানের মধ্য থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন-প্রক্রিয়া, সরকারের স্বরূপ বা মন্ত্রিসভার আকার কী হতে পারে, তা নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রিসভায় অরাজনৈতিক কাউকে রাখার বিপক্ষে আওয়ামী লীগ নেতারা। তাঁরা মনে করেন, বর্তমান সংসদ সদস্যদের নিয়ে সম্ভাব্য ওই সরকার গঠিত হতে পারে।

সরকারের ঠিক বিপরীত অবস্থানে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হলেও নির্বাচনের আগে তা পুনরায় ফিরিয়ে আনার দাবিতে অটল তারা। বিরোধী দলের নীতিনির্ধারকদের মতে, কোন দলীয় সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না। সকল দলের অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন হতে হলে সরকারকে অবশ্যই তত্ত্বাবধায়ক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক শব্দে সরকারের অসুবিধা থাকলে অন্য কোন নামে আনলেও বিরোধী দল মেনে নেবে, কিন্তু তা হতে হবে অবশ্যই নির্দলীয়। নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে সরকার রাজি হলে বিএনপিও তাতে সম্মত জানাবে। অন্য কোন পথে নয়।

সঙ্কট সমাধানে সংলাপ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে জ্বলন্ত বাহাস চললেও খুব একটা নিরাশ নন দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাঁদের মতে, সংলাপ হচ্ছে না মূলত এই একটা ইস্যুতেই। আর তা হলো নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা কেমন হবেÑ তত্ত্বাবধায়ক নাকি অন্তর্বর্তী সরকার। এ নিয়ে দু’দল মুখোমুখি হলেও নির্বাচনের আগ মুহূর্তে দেশ ও জাতির স্বার্থে উভয় পক্ষ কিছুটা ছাড় দিয়ে একটি অবস্থানে আসতেই হবে। নইলে দেশের কষ্টার্জিত গণতন্ত্র আবার নস্যাত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে এবং দু’দলের যুদ্ধংদেহী মনোভাবের কারণে তৃতীয় কোন পক্ষ সুযোগ নিতে পারে, যা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যই বুমেরাং হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন