মঙ্গলবার, ২১ মে, ২০১৩

হেফাজতের ধ্বংসলীলা

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান
সম্প্রতি হেফাজতে ইসলাম সারা দেশে যে দানবীয় তা-ব চালিয়েছে তার ভিত্তি অনেক গভীরে গ্রোথিত। হেফাজত যে জামাত-শিবির ও বিএনপির বিটিম এটা একটি বালকেরও বুঝতে বাকি নেই। হেফাজতের নেতাকর্মীরা সামাজের বিত্তশালীদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকে। এদের কিছু আরবি শিক্ষা ছাড়া তেমন জ্ঞানবুদ্ধি আছে এমনটি বলা কষ্টকর। জামাত-শিবির জানে অদূর ভবিষ্যতে তাদের দল নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। তাদের সংশোধিত গঠনতন্ত্র বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।


হেফাজতে ইসলাম সে কারণেই সারা দেশে ইসলাম রক্ষার নাম করে সরকারের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করেছে। তারা বলে, তারা রাজনৈতিক দলভুক্ত নয়। কিন্তু গত ৫ মে, ২০১৩ তারিখে মতিঝলের শাপলা চত্বরের সমাবেশে তারা আল্লাহ-রাসুল (সা.), হাদিস-কুরআনের কথা না বলে সারাক্ষণ সরকার বিরোধী বক্তব্য দিয়েছে। জননেত্রী শেখ হাসিনকে নিয়ে আপত্তিকর সেøাগান দিয়েছে, অশালীন ও ইতর ভাষায় প্যারোডি পরিবেশন করেছে। একটি ধর্মীয় সংগঠনের ব্যানারে জাতি কখনোই তা প্রত্যাশা করে না। হেফাজতের কর্মীরা বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি ব্যাংক বীমা আক্রমণ করেছে, লুণ্ঠন করেছে। বায়তুল মোকাররম মার্কেটে সোনার দোকানে লুট করেছে। সর্বোপরি পবিত্র কুরআন শরিফ ও হাদিসের দোকানে আগুন দিয়েছে। ভস্মীভূত হয়েছে লাখ লাখ টাকার ধর্মীয় গ্রন্থ। পথে বসেছে প্রায় সহস্রাধিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। বন্ধ হয়েছে তাদের রুটিরোজির পথ। এর দায় জামাত-শিবির, বিএনপি এবং হেফাজতের নেতাদেরই নিতে হবে। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণও তাদের দিতে হবে।

হেফাজত, জামাত-শিবির এবং তাদের আশ্রয়দাতা দল বিএনপি শুরু থেকেই গণজাগরণ মঞ্চকে আক্রমণ করে কথা বলছে। গণজাগরণ মঞ্চের অপরাধ, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কথা বলছে। যুদ্ধ সেøাগান ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি তুলে যুদ্ধাপরাধী এবং খালেদা জিয়ার পায়ের নিচের মাটি সরিয়ে দিয়েছে।

তারা জাগরণমঞ্চ থেকে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়ে সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেছে। এ জন্য রাজিবসহ বেশ কয়েকজন ব্লগারকে স্বাধীনতাবিরোধীরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া জাগরণ মঞ্চের ছেলেমেয়েদের ‘নষ্ট’ ‘নাস্তিক’ বলে কটূক্তি করেছে। জাগরণমঞ্চের কর্মীদের ব্যক্তিগত চরিত্র হননেও এরা পিছপা হয়নি।

প্রতিটি মসজিদের ইমাম গণজাগরণ মঞ্চ মিথ্যা তথ্য দিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে সরকারের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তুলেছে। টঙ্গীস্থ সাতাইশ উসমানিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ কাইয়ুম এক জন সভায় বলেছেÑ এ সরকার আমার নামাজের কথা বলতে দেয় না, আল্লাহ-রাসুলের (সা.) কথা বলতে দেয় না, আমরা কুরআন-হাদিসের কথা বলতে পারি না। আমাদের সরকারের বিভিন্ন বাহিনী পাকড়াও করে।

গণজাগরণ মঞ্চের নাস্তিকদের সবাইকে জামাই আদরে বিরিয়ানি খাওয়াইয়ে পালন করছে। এ সরকার নাস্তিকদের সরকার। এ সরকার জালেমদের সরকার। স্থানীয় প্রভাবশালী শিক্ষকের নেতৃত্বে প্রায় হাজার খানেক বহিরাগত ও ছাত্র লাঠিসোটা নিয়ে ৫ মে, ২০১৩ তারিখে টঙ্গীর আব্দুল্লাহপুরে অবরোধ গড়ে তোলে। ব্যাপক গাড়ি ভাঙচুর করে। হাজার হাজার মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি করে এবং পরে শাপলা চত্বরের সভায় অবস্থান গ্রহণ করে। তাদের সবার হাতে ছিল একই মাপের গজারি কাঠের লাঠি। সাতাইশ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমামের ভূমিকাও কম ছিল না। সে মিম্বারে দাঁড়িয়ে বলেছেÑ আমার আল্লাহ-রাসুলের (সা.) কথা বলতে যারা বাধা দেয়, আমার ইসলামের কথা বলতে যারা বাধা দেয় তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল হবে। এ মিছিলে অংশগ্রহণ করা প্রতিটি মুসলমানের ইমানি দায়িত্ব। পরক্ষণেই এই ইমামের নেতৃত্বে সেøাগান দিতে দেখা গেছে, শাহবাগের আস্তানাÑ গুঁড়িয়ে দাও পুড়িয়ে দাও, নাস্তিকের আস্তানাÑ গুঁড়িয়ে দাও পুড়িয়ে দাও, নাস্তিকের চামড়াÑ তুলে নেবো আমরা, ইত্যাদি। এরা সুকৌশলে সাদাচরণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে উত্তেজিত করে তুলতে দারুণভাবে সহায়তা করেছে। সরকারের বিপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সহায়তা করে চলেছে। অথচ এরা প্রায় সবাই অন্যের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকে।

বগুড়া, ফটিকছড়ি, জয়পুরহাট, কানসাট, সাতক্ষীরাসহ সারাদেশে একইভাবে মসজিদের মাইক ব্যবহার করে মানুষকে ভুল তথ্য দিয়ে সহিংসতায় অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এতে অনেক হতাহাত এবং কোটি কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করা হয়েছে। বিএনপি, জামাত-শিবির, হেফাজতে ইসলাম এবং তাদের গোত্রীয় ইমাম ও মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক ঐক্যবদ্ধ হয়ে ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষকে বিপথে ঠেলে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে নিজেকে এবং তার সরকারকে নিয়োজিত করেছিলেন তখনও এই মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী গোষ্ঠী কৌাশলে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। তারা অপপ্রচার করেছেÑ বঙ্গবন্ধু ধর্ম মানে না। পঁচিশ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ করে দিলে তখনেও তারা অপপ্রচার করেছে শেখ মুজিব ধনি-গরিব সব এক করে ফেলবে এবং ধনিদের জমি নিয়ে গরিবদের দেবে। এদেরই একটি অংশ জিয়া-মুস্তাক গং এবং স্বাধীনতা বিরোধী গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সালের এক কালে রাতে। যে শোক আজো বাঙালি ভুলতে পারেনি। হেফাজতে ইসলাম ৫ মে, ২০১৩ তারিখে বিকাল ৫টা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করবে বলে ডিএমপি কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদনের প্রেক্ষিতে অনুমতি নিয়েছিল। তাদের সারাদিনের কার্যকলাপ দানবীয় তা-ব জাতি বিস্ময়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছে। খালেদা জিয়া হেফাজতি আগুনে তেল ঢেলেছে। তিনি যখন নেতা কর্মীদের হেফাজতের পাশে খাদ্য ও পানীয় নিয়ে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান, হেফাজতের নেতারা তখন তাদের পূর্বের প্রতিশ্রুতি ভুলে ঘোষণা দিতে থাকেÑ সরকার তাদের তেরো দফা দাবি না মানা পর্যন্ত শাপলা চত্বর থেকে তারা যাবে না। এর পরের ঘটনা সবার জানা। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছেÑ যে ব্যক্তির হাত থেকে, চক্ষু-কর্ণ থেকে, হাত-পা থেকে অন্য মানুষ নিরাপদ না, সে ব্যক্তি প্রকৃত মুসলমান না। তাহলে হেফাজতে ইসলাম ও তাদের দোসর যারা প্রতিনিয়ত মানুষ হত্যা করছে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করছে তারা কোন পর্যায়ের মুসলমান? যে ইমাম হরহামেশা মিথ্যে বলে সরলপ্রাণ মুসলমানকে অন্যায়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে সে কোন শ্রেণীর মুসলমান? মিথ্যেবাদী ইমামের পেছনে নামাজ আদায় করলে সে নামাজ আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের দরবারে কতোটুকু কবুল হবে তাও ভাববার বিষয়।

বিএনপি, জামাত-শিবির এবং হেফাজতে ইসলাম একই সূত্রে গ্রোথিত। এরা একটি বৃত্তের মধ্যে আবর্তিত। এদের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। তা হলো যুদ্ধাপরাধদের বিচার ব্যাহত করা। সরকারকে অন্তর্জাতিকভাবে পর্যুদস্ত করা, হেয় করা। অর্থনৈতিকভাবে দেশকে পঙ্গু করে দেয়া। শিক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করা। নারী শক্তিকে গৃহবন্দি করা। প্রগতির আলোকিত সকল পথে কালিমা লেপন করা। জাতিকে তালেবানি রাষ্ট্রে পরিণত করা। সর্বোপরি মানুষকে পথে বসানোর নীলনকশা বাস্তবায়নে ব্যস্ত এরা। এদের এ হীন উদ্দেশ্য কোনোদিনই বাস্তবায়িত হবে না। বাঙালি জাতি তা মেনে নেবে না। এর ফয়সালা ১৯৭১ হয়ে গেছে। জামাত-শিবির নির্লজ্জ বেহায়া, তাই এখনো এ দেশে রাজনীতি করছে। এ দেশ যে ওদের নয়, এরা এ কথা ভুলে গেছে।

জামাত এবং বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তারা এ তেরো দফা বাস্তবায়ন করেনি কেন? সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ সরকারকে হেফাজতিদের দাবি মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে তিনি যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন কিন্তু এ ধরনের কার্যক্রম তিনি নিজেই হাতে নিতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করেননি। এরা একই রসুনের বিভিন্ন কোষ মাত্র। সুযোগ বুঝে কথা বলেন, ঝোপ বুঝে কোপ মারেন। এটা সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে, উন্নয়নের চাকাকে সচল রেখে, প্রগতির আলোর পথ উন্মুক্ত রেখে, কথা বলতে হবে। কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে। তা না হলে বিএনপি, হেফাজত, জামাতের ৫ মে এর কর্মসূচির মতো সব বুমেরাং হতে বাধ্য।

জনগণ কখনোই অনগ্রসর ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ওপর নির্ভরশীল হতে চায় না। পৃথিবীর কোনো অনুন্নত দেশেও সম্ভব নয়। বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ায় টাইগার হতে চলেছে। এ কথা এখন উন্নত দেশের কর্তাব্যক্তিদের মুখেও উচ্চারিত হচ্ছে। হেফাজতের আখেরি খায়েস ক্ষমতায় যাওয়ার। বাবু নগরীকে নাকি মন্ত্রী বানানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। আমরা তাদের সাধুবাদ জানাই। রাজনৈতিক দল গঠন করে নির্বাচনে অংশ নিন শতকরা তিনটে ভোট পান কিনা যাচাই করে দেখতে পারেন।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রী আশরাফুল ইসলামের কথার রেশ ধরেই বলতে চাই, হেফাজতের নেতাকর্মীরা কোনো না কোনো মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষক কিংবা মসজিদের ইমাম। মাদ্রাসা বা মসজিদের পৃষ্ঠপোষক সমাজের বিত্তশালীরা। সরকারের উচিত হবে মাদ্রসা এবং মসজিদের ওপর নজরদারি বৃদ্ধি করা। মসজিদের ইমামরাও একাট্টা হয়ে এগিয়ে আছে। কিছু বললেই বলেÑ আপনি মুসলমান না? ইসলাম গেলো, ধর্ম গেলো বলে জিকির শুরু করে দেয়। এই অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। সমাজে যারা ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে তারা কখনোই বেহেস্তে যাবে নাÑ আল হাদিস। অতএব আমরা দেশে ফ্যাসাদ সৃষ্টি থেকে বিরত থাকি এবং দেশকে এবং দেশের মানুষকে ভালোবাসতে শিখি। এটা ঈমানের অংশ।

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান : কথাসাহিত্যিক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন