মঙ্গলবার, ২ এপ্রিল, ২০১৩

জয়গুলো কেন এমন পরাজয় হয়ে যায়?

শাখাওয়াৎ নয়ন, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
সরকার গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙে দিতে বলছে। এতো দিন সরকারবিরোধীরা গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙে দিতে চাপ দিচ্ছিল। সরকারের শরিক হুমু এরশাদ গত কয়েকদিন ধরে পরিষ্কারভাবে গনণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে কথা বলে যখন মানুষের কাছে হাসির পাত্র হচ্ছিলেন। ঠিক তখন আওয়ামী লীগ সরকার এরশাদের সাথে গলা মিলিয়েছে। বিষয়টি যদিও পরিষ্কার নয়। সরকারই কি এরশাদকে দিয়ে এমন আগাম বার্তা দিয়েছে? নাকি এরশাদের কথাই সরকারের মনে ধরেছে? যথেষ্ট চিন্তার বিষয়। গণজাগরণ মঞ্চ থেকে সরকারের কি সব কিছু পাওয়া হয়ে গেছে? নাকি সরকার ভাবছে, গনজাগরণ মঞ্চ যতদিন থাকবে ততদিন নাস্তিকতা বিরোধী আন্দোলনের নামে ধর্মান্ধরাও রাজপথে বিভিন্ন কর্মসূচী দেবে।
সুতরাং গনজাগরণ মঞ্চ গুটিয়ে নিতে হবে। কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙে দিলে জামায়াত-বিএনপি যে বিজয় মিছিল করবে, সেই বিজয় মিছিল থেকেই সরকার পতনের ডাক দিতে পারে। তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য বিএনপির লোকেরা তোরণ নির্মাণ করা শুরু করে দিতে পারে। জামায়াতিরা যুদ্ধাপরাধীদের অবিলম্বে মুক্তির দাবি তুলে পারে। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আনিসুল হকের মতো লোকদের বিচার দাবি করতে পারে। সরকার তখন সামাল দেবে কিভাবে? গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙে দেওয়ার কথা বলার আগে একবারও কি প্রধাণমন্ত্রীর মনে আসা উচিৎ ছিল না, গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠকদের সাথে আলোচনায় বসার কথা? সরকার কি একবারও ভেবে দেখেছে, গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠকদের নিরাপত্তার কথা? তাদের দাবির কথা? তাদের স্বপ্নের কথা? সম্ভবত ভাবছে না। অথচ তাদের স্বপ্নই আগামী দিনের বাংলাদেশ। তারা যদি হেরে যায়, বাংলাদেশ হেরে যাবে। তাদের স্বপ্ন যদি ভঙ্গ হয় বাংলাদেশ ভেঙে তছনছ হয়ে যাবে। বাংলাদেশ তালেবানি রাষ্ট্র হয়ে যাবে। পাকিস্তানের মতো পিছনের দিকে চলা শুরু করবে। শেখ হাসিনাকে মনে রাখতে হবে, জামায়াতি, হেফাজতিরা কোনো দিনই খালেদা জিয়াকে ছেড়ে যাবে না। বিএনপিকে বগলদাবা করে রাখবে। কিন্তু আজকের এই জেগে ওঠা তরুণ প্রজন্ম কিন্তু আপনাকে ছেড়ে যেতে পারে। তারা একবার যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে খবর আছে।

তরুণ প্রজন্ম কিন্তু সরকারের ডাকে শাহবাগে আসেনি, সরকারের ধমকে তারা শাহবাগ ছেড়ে যাবে কেন? সরকার চাইলে পুলিশ দিয়ে উৎখাত করতে পারবে, কিন্তু সরকারকে মনে রাখতে হবে শাহবাগ এখন আর শাহবাগে নেই। শাহবাগ ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। শাহবাগ চিরস্থায়ী হয়ে গেছে মানুষের মনে, অন্তরে। সেখান থেকে কেউ উৎখাত করতে পারবে না। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি “নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করুন” শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। আজকের এই জেগে ওঠা তরুণরা কিন্তু যে কোনো কিছু করার ক্ষমতা রাখে। তারা অনশনের মতো কর্মসূচী দিয়েছে। তারা কিন্তু বিপ্লবী সংগঠনও তৈরি করতে পারে। শাহবাগে আমি এমন অনেক তরুণের সাথে কথা বলে জেনেছি। তারা স্পষ্ট ভাষায় দৃঢ় কণ্ঠে বলেছে, তারা কিন্তু “ক্র্যাক প্লাটুন” গঠন করতে পারে। সুতরাং এক মাঘে শীত যাবে না। অহিংস আন্দোলন করলে যে আর কোনো দিনই সহিংস আন্দোলন করা যাবে না, তা তো নয়। দিল্লি, আগরতলা এবং কলকাতা তাদেরকে সমর্থন করেছে। হাজার হাজার প্রবাসী বাঙালি সকল নিয়ে বসে আছে। রক্ত লাগলে রক্ত দেবে, টাকা লাগলে টাকা। সুতরাং সময়ই বলে দেবে, সময়ের প্রয়োজনটা কি?

মার্চ মাসের শুরুতে “জামায়াত ইসলামীর নতুন পরিকল্পনা" শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। লেখাটির মূল বক্তব্য ছিল, যেভাবেই হোক জামায়াত-শিবির এই যাত্রায় নিজেদের রক্ষায় সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতায় আনার জন্য যা যা করা দরকার তাই করবে। সেই মোতাবেক কাজ শুরু করে দিয়েছে। ইতোমধ্যে, পদ্মা, মেঘনায় অনেক জল গড়িয়ে গেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় জামায়াত শিবিররা সরাসরি পুলিশকে চ্যালেঞ্জ করছে। স্বাধীন বাংলাদেশে আর কোনো রাজনৈতিক দল এমন ধৃষ্টতা কখনই দেখাতে পারেনি। তার মানে কি? পুলিশ দিয়ে জামায়াত-শিবিরকে দমন করা যাবে না? আমি মনে করি, যাবে না। কারণ সরকারের মেয়াদকাল প্রায় শেষের দিকে। প্রশাসনে জামায়াত-বিএনপির লোকেরা অ্যাকটিভ হচ্ছে। তারা সরকারের নির্দেশ ঠিকমত পালন করছে না। অনেক গোপন তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছে। তাছাড়া পুলিশ দিয়ে শুধুমাত্র কিছু ছিঁচকে চোর, নিরীহ মানুষ ধরে এনে লাল দালান দেখানো যায়। বড় কোনো ডাকাত কিংবা সন্ত্রাসীদের ধরা যায় না। কখনো কখনো দুই একটাকে ধরতে পারলেও নানা রকম নাটক শেষে পরবর্তীতে বেরিয়ে আসে।

অতএব ছাত্রশিবির একটি চরমপন্থী, সন্ত্রাসবাদী সংগঠন, এদের মোটিভেশন, প্রশিক্ষণ এবং প্রস্তুতি ভিন্ন ধরনের। কেবলমাত্র একটি জঙ্গি, চরমপন্থি, সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের পক্ষেই পুলিশকে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব। আওয়ামী লীগ, বিএনপি জীবনেও এসব করতে পারবে না।  তাই এদেরকে দমন করতে হলে অবশ্যই আরো শক্তিশালী কোনো বাহিনী দরকার। অপারেশন ক্লিন হার্ট, চিরুণী অভিযান ধরনের অভিযানের অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। এখন প্রয়োজন “অপারেশন ক্লিন বডি”। সমগ্র দেশে এক সাথে অপারেশন চালাতে হবে। যে কোনো মূল্যে জামায়াত শিবির দমন করতে হবে। তাছাড়া তারা আর কাউকেই পাত্তা দেবে না। শেখ হাসিনা সরকারকে হুমকি গৃহযুদ্ধের দিয়েছে, খালেদা জিয়াকে আগাগোড়া ধমকের উপরে রাখবে। এখন থেকে পাঁচ দশ বছরের মধ্যে তারা মওদুদী বিপ্লবের ডাক দিয়ে একক ভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার চিন্তা করবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, জামায়াত কিন্তু কখনই চিন্তা করে না যে, বাংলাদেশের মানুষ তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসাবে। তারা উপযুক্ত শক্তি অর্জন করতে পারলেই ক্ষমতা দখল করে নিবে। এটাই তাদের মিশন এবং ভিশন।

উক্ত নিবন্ধে লিখেছিলাম, ‘খালেদা জিয়াকে দিয়ে তারা সেনাবাহিনীকে উসকে দেবে।‘ খালেদা জিয়া তাই করেছেন। হায়রে খালেদা জিয়া, আপনি বুঝতে পারবেন। একটু অপেক্ষা করুন। জামায়াত-শিবির আপনার মুখের সামনে ক্ষমতার মুলা ঝুলিয়ে আপনার পিঠে চড়ে বসেছে। আপনি দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে মানসিক রোগীর মতো উলটা-পাল্টা কথা বলছেন। আপনি জেনে রাখুন, আসলে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য জামায়াত এতো কিছু করছে না। তারা বুঝে গেছে বিএনপিকে দিয়ে রাজাকারদের বাঁচানো যাবে না। কারণ অতীতে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের তারা বাঁচাতে পারেনি।

উল্লেখ্য, এক সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াত-শিবিরের দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে বিএনপিপন্থী ছাত্র শিক্ষকরা আওয়ামী লীগের সাথে ঐক্য গড়ে তুলেছিল।  একদিন সমগ্র বাংলাদেশে সেই অবস্থা তৈরি হতে পারে।

তাহলে উপায় কি গোলাম হোসেন? উপায় আর কি? দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির কোনো কর্মকাণ্ড নেই বললেই চলে। পল্টনের অফিসে মির্জা ফখরুল ইসলাম এবং ধানমন্ডীতে বসে মাহবুবুল হক হানিফ শুধুমাত্র তোতা পাখির চরিত্রে অভিনয় করছেন। এসবে কোনো কাজ হবে না। আওয়ামী লীগ যদি শিবির দমন করতে ব্যর্থ হয় তাহলে বাংলাদেশে আবার একজন সেনা শাসকের অভিষেক হতে পারে। নয়তো জামায়াত-বিএনপি জোট ক্ষমতায় আসবে। তারা ক্ষমতায় এলে সেটি হবে জামায়াত-প্রধান সরকার। জামায়াত নেতারা ভেবে দেখবেন, বিএনপি থেকে কয়জনকে মন্ত্রী বানানো যায়। অবশ্যই কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে নয়, কিংবা মুক্তিযোদ্ধার ছেলেকেও নয়। যেহেতু আন্দোলনে বিজয়ী দল জামায়াত সেহেতু কে হবেন রাষ্ট্রপতি? প্রধানমন্ত্রী হবেন কে? বিরাট ভাবনা চিন্তার বিষয়। তখন কিছু কাপুরুষ রাজনীতিবিদ আর মগজ বন্ধক দেয়া বুদ্ধিজীবিরা চ্যানেল ‘ফোরটোয়েন্টি’তে মুসলিম জাতীয়তাবাদ বলে বলে জিকির আসকান করবেন। পাকিস্তান দূতাবাসে ফ্যাশন উইকে বোরকা, টুপি এবং পাঞ্জাবির ফ্যাশন শো সরাসরি দিগন্ত টেলিভিশনে প্রচার করবে। বিটিভিতে রাত আটটার সংবাদের আগে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় গোলাম আযমের বলা কোনো উক্তি ইনভারটেড কমা দিয়ে প্রচার করবে। তখন আম-জনতারা মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে দাউদ হায়দারের কবিতার মতো করে বলবে, আমাদের সব জয়গুলো কেন এমন পরাজয় হয়ে যায়?

লেখকঃ ব্লগার, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, গবেষক। ইউনিভার্সিটি অফ নিউক্যাসল। অস্ট্রেলিয়া।

ইমেইলঃ shakhawatnayon@gmail.com 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন