রবিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৩

আওয়ামী লীগ বন্ধুকে শত্রু মনে করে কেন?

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমানের আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোটকে ক্ষমতায় আনতে বড় ভূমিকা রেখেছিল বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি-দক্ষতায় দক্ষ প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা যারা বাংলাদেশের জন্মের অসম্পূর্ণ এক যুদ্ধ-যুদ্ধাপরাধীর বিচারকে সম্পন্ন এবং ’৭১-এর ঘাতক দলের রাজনীতি বন্ধ করে বাংলাদেশের ইতিহাসকে কালিমা ও কলঙ্কমুক্ত করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করে চলেছে।

৫ ফেব্রুয়ারি এই তরুণ-তরুণীরা যখন জেনেছিল ট্রাইব্যুনাল মিরপুরের কসাই কাদেরকে ফাঁসি না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছে, সেদিনই তারা জেনেছিল ’৭৩-এর আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনটিতে আসামি পক্ষকে আপিল করার সুযোগ দিলেও এতে রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ যারা খুন-নিহত-আহত-ধর্ষিতার পক্ষে। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বাদী তাদের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কোন সুযোগ নেই! উপরন্তু তারা দেখেছে বঙ্গবন্ধু হত্যার দোষীসাব্যস্ত হওয়া আসামিদের খালেদা জিয়া শাস্তি মওকুফ করে মুক্তিদান করেছে! সুতরাং ক্ষমতার পালাবদল হলে এই খুনী কসাই-ধর্ষকেরা আবারও মুক্তি পেয়ে যাবে- এ আশঙ্কা থেকে তারা শাহবাগে একত্রিত হয়ে দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি বা সর্বোচ্চ শাস্তি এবং জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে সব ধরনের শ্রেণী-পেশার নারী পুরুষ-তরুণ-তরুণী-বালক-বালিকা-শিশুদের বিশাল জমায়েতে ঐক্যবদ্ধ করে ফেলে যা ’৭১-এর ঘাতকদের বিচারের জন্য অনুষ্ঠিত গণআদালতের পর অদৃষ্টপূর্ব একটি গণজাগরণ জমায়েত!
দেইল্লা রাজাকার বা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মৃত্যুদ- ঘোষিত হলে জামায়াত-শিবির-বিএনপি একযোগে হরতাল ও দেশজুড়ে অনেকটা ’৭৪, ’৭৫-এর মতো ধ্বংসাত্মক অপকর্ম শুরু করে যার মধ্যে ’৭১, ২০০১-এর মতো হিন্দু ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীর বাড়িঘর, মন্দির, সম্পদ, ব্যবসা-জীবিকা ধ্বংস করা হয়, আবার বিশেষ করে পুলিশ ও দেশের উন্নয়নমুখী রেল যোগাযোগ, বাস-ট্রাক, গাড়ি, সিএনজি, মোটরবাইক, এমনকি ভ্যান-রিকশায় আক্রমণ করে পেট্রোল ও গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন জ্বালিয়ে ধ্বংস করেছে। অপরদিকে ইন্টারনেটে জামায়াত-শিবির মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপপ্রচার চালাতে থাকলে শাহবাগের মুক্তিযুদ্ধপন্থী সাইবার যোদ্ধারা এসব অপপ্রচারের উত্তর দিতে থাকে। এর মধ্যে জামায়াত-শিবির-বিএনপি চাঁদের ছবিতে সাঈদীর ছবি যোগ করে গ্রামে-গঞ্জে স্মরণাতীতকালের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করে, এদের হাতে প্রায় আট পুলিশ নিহত হয়, নিহত হয় ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাকর্মী! এর মধ্যে আকস্মিকভাবে জামায়াতের লক্ষ্য নিয়ে চট্টগ্রামে হেফাজতে ইসলাম নামে অপরিচিত এক মৌলবাদী সংস্থা শাহবাগের তরুণদের কাফের, মুরতাদ ঘোষণা করে তাদেরকে নাস্তিক ও ইসলামের সমালোচক হিসেবে গ্রেফতার করার দাবি জানায়! বোঝা কঠিন নয় যে, জামায়াত মুক্তিযুদ্ধপন্থী এই তরুণদের জাগরণকে এবং দাবিকে ভয় পেয়ে একটি সুযোগ সন্ধানী দলকে তাদের নিজস্ব উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যবহার করতে শুরু করে যা তারা এর আগেও বাংলা ভাই-এর জেএমবি, জেএমজেবি, হরকাত-উল জিহাদ, আল্লাহর দল ইত্যাদি দল গঠন করে দেশকে মুক্তিযুদ্ধ চেতনাপন্থীহীন, গণতন্ত্রহীন, নারী স্বাধীনতাহীন, হিন্দু-আদিবাসীহীন করে শরিয়া রাষ্ট্র করতে চেয়েছিল! বর্তমান সময়ে তারা হাটহাজারীর কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক অচেনা হেফাজতে ইসলাম নামের দলটির ঘাড়ে ভর করে লংমার্চসহ নানা নাশকতা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিদার ব্লগারদের বিরুদ্ধে সরকারকে অবস্থান নিতে বাধ্য করছে। সরকারও তাদের দাবি মানছে।
আশ্চর্য এই যে, যে শেখ হাসিনা শাহবাগের তরুণ প্রজন্মের গণজাগরণের পর সংসদে বলেছিলেন এবার তিনি শান্তিতে মরতে পারবেন, মৃত্যু হলেও আর কোন আফসোস থাকবে না কেননা তরুণরা জেগেছে এবং তারাই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে রক্ষা করবে। এখন এই জামায়াতপন্থী হেফাজতের দাবি পূরণ করতে তিনি এই ডিজিটাল তরুণদের গেফতার করতে শুরু করেছেন। পুরো জাতি বিস্মিত! প্রশ্ন উঠেছে-
১. ২০০৬-এ এ রকম একটি মৌলবাদী দলের সঙ্গে তিনি যখন নির্বাচনী চুক্তি করে ফেলেছিলেন, তখন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির চাপে কালো চুক্তিটি বাতিল করায় তখন আওয়ামী লীগ তার গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ দলের রূপটি হারায়নি এবং ২০০৮-এর নির্বাচনে তাঁর দলকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে সক্ষম আগ্রহী দল বিবেচনা করে এই ডিজিটাল প্রজন্ম ভোট দিয়ে বিজয়ী করেছিল! তাঁর কি বিশ্বাস যে এই শরিয়াপন্থী যারা রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামোর বাইরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিপুল অর্থ এনে দরিদ্রের ছেলেদের মাদ্রাসার প্রাচীন মধ্যযুগীয় শিক্ষা ও তাদের অনেকে জঙ্গী জেহাদি ইসলামপন্থী হিসেবে তৈরি করেন, তারা কিভাবে ধর্মনিরপেক্ষ, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে আওয়ামী লীগকে একটি ভোটও দেবে? অথচ বিপরীতে তিনি আধুনিক ডিজিটাল প্রজন্মের কোটি তরুণ-তরুণীর ভোট হারাতে বসেছেন। মনে রাখতে হবে- এখনকার লড়াই হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যেকার লড়াই। কওমী মাদ্রাসা তো এ সরকারকে মানে না, তারা জামায়াতের অনুসারী এবং পূর্ব পাকিস্তান রক্ষায় বা পুনর্গঠনে আগ্রহী, তা না হলে তারা তো শিক্ষামন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সরকারী শিক্ষাক্রমে মাদ্রাসাগুলোকে সাজাতেন। তারা রাষ্ট্রের বাইরে অবস্থান করেন।
২. এ ধরনের সরকার অমান্যকারীরা কিভাবে নিয়ম ভেঙ্গে দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে? তাদের আয়ের উৎস কি- অবিলম্বে তা সরকারকে বের করতে হবে। তারা সরকারৎবিরোধী লংমার্চ করবে, কিন্তু তারা তাদের আয়ের ওপর কর দেন কি? তাদের ছাত্রেরা এসব মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে কি?
৩. সরকার কি বুঝতে পারছে যে কোটি বন্ধুকে শত্রু বানাতে তারা বাক-স্বাধীনতা ও অবাধ তথ্য প্রযুক্তির যুগে ব্লগ লেখার জন্য তরুণদের গ্রেফতার করবেন? আর যারা প্রকৃতই সাঈদীর ছবি নিয়ে, কাবা শরীফ নিয়ে, অন্যের নামে কটূক্তিপূর্ণ ব্লগ, ভিডিও তৈরি করেছে, তারা তো সরকারের হাতের বাইরে। লন্ডনে, পাকিস্তানে!
আমরা যে মানবধর্ম সব ধর্মের মূল- সব ধর্মের মানুষকে ভালোবাসা, দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, দয়া, করুণা সততা, সত্যবাদিতা ইত্যাদি গুণগুলো আজকের আধুনিক শাহবাগের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে দেখছি, তাদেরকেই কঠিন আঘাত করা হলো কেন- হাজারো মানুষ আজ এ প্রশ্ন তুলছে। ওরা বলছে- আওয়ামী লীগ শত্রুকে তোষামোদ করে আক্রান্ত হয় আর বন্ধুকে দূরে ঠেলে দিয়ে নিজেকে সেই সাথে জাতিকে, চরম ক্ষতিগ্রস্ত করে। বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন কি এর উদাহরণ?
প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করব- মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসই আওয়ামী লীগের শক্তি। কোন কারণে এ আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তি ও দলকে বিশেষ করে ডিজিটাল প্রজন্মকে নিজের পক্ষে রাখুন-তাহলেই বিজয়ী হবেন! নতুবা তরুণ-তরুণীরা, তাদের পরিবার নির্বাচনে ভোটদানে বিরত থাকবে আর আওয়ামী লীগ হারাবে প্রায় এক কোটি ভোট!
প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল প্রজন্মকে দিয়েই তো ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠিত হবে, মোল্লা, ফতোয়াবাজ মৌলবাদীরা জাতিকে পেছনেই নিয়ে যাবে।
বর্তমান অস্থিরতা, নাশকতা বন্ধ হয়ে যাবে যখন যুদ্ধাপরাধীর বিচার শেষ হয়ে দ- কার্যকর হবে- এটি নিশ্চিত।
মমতাজ লতিফ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন