শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন, আখতারুজ্জামান আজাদ ও ওমর হাসান আল জাহিদ
৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলনকে সঙ্গত কারণেই তুলনা করা হচ্ছে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এবং এই শাহবাগের আন্দোলনই বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পুনর্জাগরিত করেছে। ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশের ৪২ বছরের দুর্ভেদ্য অচলায়তন।
৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলনকে সঙ্গত কারণেই তুলনা করা হচ্ছে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এবং এই শাহবাগের আন্দোলনই বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পুনর্জাগরিত করেছে। ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশের ৪২ বছরের দুর্ভেদ্য অচলায়তন।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধী জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের প্রদত্ত রায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে শাহবাগে সমবেত হয়েছিলেন লাখো বাঙালি, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম। এ জনতার ঢলকে নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখেছে জামায়াতে ইসলামী। ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে জামায়াতচক্র প্রজন্ম চত্বরের বিরুদ্ধে চালিয়েছে ন্যক্কারজনক অপপ্রচার। এ জন্য তারা বেছে নিয়েছে প্রথমে ফেসবুককে ও পরে 'দৈনিক আমার দেশ'কে। এই দুটি মাধ্যমে প্রথমে তারা শাহবাগকে গঞ্জিকাসেবীদের সমাবেশ হিসেবে প্রচার করলেও এই নিম্নমানের শিশুতোষ অপপ্রচার সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। পরে তারা প্রচার করে, শাহবাগে আগত ব্যক্তিরা অর্থের লোভে সমাবেশে আসে। কিন্তু সচেতন মানুষের মনে এই হাস্যকর প্রচারটিও দাগ কাটতে পারেনি।
প্রজন্ম চত্বরে আগত ব্যক্তিবর্গ এসেছিলেন ভেতরের তাগিদ থেকে। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করেন, যারা বাংলাদেশকে কবিগুরুর সোনার বাংলা করতে চান, যারা গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চান, তারাই ছুটে এসেছিলেন শাহবাগে। অবুঝ শিশুটি থেকে সবুঝ বৃদ্ধটি পর্যন্ত এখানে এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের প্রতি ইস্পাতকঠিন এক প্রতিশ্রুতি থেকে। লাখো মানুষের সমাবেশ দেখে জামায়াতচক্র ফন্দি আঁটে। তারা প্রচার করে, শাহবাগের গণজমায়েত একটি রাজনৈতিক সমাবেশ। আওয়ামী লীগ এই আন্দোলনকে বসিয়েছে। কিন্তু এই অপপ্রচারটিও কার্যকর হয়নি। শাহবাগে সমাবেশ ডেকেছিলেন সচেতন বল্গগার ও অনলাইন কর্মীরা। অনলাইন কর্মীদের আহূত সেই গণআন্দোলনে একে একে যুক্ত হয়েছেন সংস্কৃতিকর্মী, ছাত্র-শিক্ষক, চিকিৎসক, লেখক-প্রকাশক থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বস্তরের নাগরিকবৃন্দ এবং সেই সমাবেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও এসেছিলেন সংহতি প্রকাশ করতে। মনে রাখতে হবে, রাজনীতিকরা রাষ্ট্রের বাইরের কেউ নন। তারাও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কামনা করতে পারেন। সংহতি প্রকাশ করতে পারেন সমাবেশের সঙ্গে। এ ব্যাপারে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে_ জামায়াতের মতো ক্যাডারসর্বস্ব, অর্থবলে বলীয়ান ও নৈরাজিক দলের নেতাদের বিচারের জন্য শক্তিশালী রাজনৈতিক ইচ্ছা প্রয়োজন। ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে নাজিদের বিচার করার সময় ও ওই বিচারের পেছনেও শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি ও ইচ্ছা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যে ১৪ দলীয় জোট এখন ক্ষমতায়, তারাও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার করতে বদ্ধপরিকর এবং আশার কথা হচ্ছে, শাহবাগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদের বিচারের ব্যাপারে সারাদেশের সর্বস্তরের মানুষ তাদের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনের কথা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন।
শাহবাগ আন্দোলনের ব্যাপ্তি, গভীরতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা দেখে প্রথমদিকে বিএনপি মৌনতা অবলম্বন এবং জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখলেও, আস্তে আস্তে বিএনপি তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে। বিশেষ করে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে আসার পর বিএনপি সুস্পষ্টভাবে জামায়াতের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। তারা শাহবাগ আন্দোলনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে থাকে। বিএনপি প্রজন্ম চত্বরকে সরকারের সাজানো নাটক বলছে। এর নেতারা বলছেন, সরকার শাহবাগকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে। বিএনপি যখন এটি মনেই করছে, তখন বিএনপিও পারলে এমন একটি নাটক সাজিয়ে দেখাক। পারলে বিএনপিও এভাবে সর্বস্তরের জনতাকে হাজির করে সপ্তাহের পর সপ্তাহ 'নাটক' মঞ্চস্থ করুক। সরকার যদি শাহবাগ থেকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করে থাকে, শাহবাগকে যদি ব্যবহার করে রাজনৈতিক স্বার্থে; তাহলে বিএনপি শাহবাগ থেকে কেন রাজনৈতিক ফায়দা নিতে পারল না? বিএনপি কেন পারল না শাহবাগকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে? বিএনপি যদি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে শাহবাগে এসে যোগ দিত, তাহলে শাহবাগ কি বিএনপিকে বরণ করে নিত না? আমরা যেন ভুলে না যাই, প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলন শুরু হয়েছিল প্রচণ্ড ক্ষোভ ও হতাশা থেকে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে যেমন মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছে, সরকারও তেমনি নানা বিষয়ে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। আমরা মনে করি, বিএনপি খুব সহজেই শাহবাগে এসে তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সরকারকে চাপের মুখে ফেলতে পারত। মূলত জামায়াতকে সঙ্গে রেখে বিএনপি কখনোই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইতে পারে না এবং শাহবাগ থেকে ফায়দা হাসিল করা দূরের কথা, বিএনপিতে কয়েকজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা থাকা সত্ত্বেও জামায়াতের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে বিএনপির কোনো নেতা কিংবা বিএনপিপন্থি কোনো বুদ্ধিজীবী শাহবাগে পা রাখারই সাহস রাখেন না। ফলে শাহবাগ থেকে কোন দল রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করল_ সেই প্রশ্ন তোলার নৈতিক অধিকারটুকুও বিএনপির নেই। এ ক্ষেত্রে টর্ট আইনের একটি নীতি বিশেষভাবে স্মর্তব্য_ 'ঐব যিড় ংববশং বয়ঁরঃু সঁংঃ পড়সব রিঃয পষবধহ যধহফং.'
শাহবাগে নারীদের অংশগ্রহণ অভূতপূর্ব। বাংলাদেশের যে নারীরা প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথেও নির্যাতনের আশঙ্কামুক্ত নন, সেই বাংলাদেশে প্রজন্ম চত্বর ছিল (ও আছে) নারীদের জন্য নিরাপদতম এক স্থান। এখানে গভীর রাত পর্যন্ত নর-নারীরা পাশাপাশি বসে দৃপ্ত স্লোগান দিয়েছেন। একসঙ্গে পাশাপাশি হেঁটে রাজপথে অংশ নিয়েছেন উদ্দীপ্ত মশাল মিছিলে। কোথাও বিন্দুমাত্র বিশৃঙ্খলা হয়নি, কোনো নর ঝাঁপিয়ে পড়েনি কোনো নারীর ওপর, কোনো যুবক বাঁকা মন্তব্য ছুড়ে দেয়নি কোনো যুবতীর দিকে। যে বাবা-মা তাদের মেয়েকে কখনোই বাইরে যেতে দেন না, তারাও মেয়েকে নিদ্বর্িধায় শাহবাগে আসতে দিয়েছেন, কখনও-বা নিজেরাও এসেছেন। জামায়াতি অপপ্রচার চক্র সেই নারীদেরও কালিমালিপ্ত করার অপচেষ্টা করেছে। শাহবাগে আগত নারীদের নিয়ে তারা মেতে উঠেছে অশ্লীল-অসভ্য প্রচারণায়। জামায়াতি অপপ্রচারের মোটামুটি সব অস্ত্রই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্রমশ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। স্মর্তব্য যে, মাতৃ জাতিকে যারা কলঙ্কিত করে, কালিমালিপ্ত করে; তাদের সমূহ পতন অনিবার্য-অবশ্যম্ভাবী। পৃথিবীর ইতিহাসে তার অসংখ্য নজির রয়েছে।
শাহবাগের গণজাগরণকে যখন কোনোভাবেই দ্বিখণ্ডিত করা যায়নি, তখন অত্যন্ত সুকৌশলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আস্তিকতা-নাস্তিকতার ধুয়া তুলে বিরোধী চক্রটি শাহবাগকে বিভক্ত করার প্রয়াস নিয়েছে। একাত্তরে জামায়াত প্রচার করেছিল_ মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের দালাল, মুরতাদ ও নাস্তিক। ২০১৩ সালেও একইভাবে জামায়াত শাহবাগের আন্দোলনকারীদের নাস্তিক বলে প্রচার করেছে। মুরতাদ আখ্যা দিয়ে জামায়াত একাত্তরে অসংখ্য বাঙালি বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছিল। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানি বাহিনীর চেয়ে জামায়াতের গরজই বেশি ছিল বলে আমরা পাকিস্তানি মেজর রাও ফরমান আলির বক্তব্য থেকে জেনেছি। সেই জামায়াত ২০১৩ সালে একইভাবে নাস্তিকতার ধুয়া তুলে একটি গণজাগরণকে দ্বিখণ্ডিত করার অপচেষ্টা করছে। মূলত শাহবাগে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষই এসেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে বাংলাদেশকে রক্ষা করার তাগিদ থেকে।
শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলন আমাদের চেতনাকে নতুন গতি দিয়েছে। প্যারিসের ছাত্র আন্দোলন, ওয়াল স্ট্রিট দখল আন্দোলনসহ অনেক গণসংশ্লিষ্ট ও যুগান্তকারী বৈশ্বিক আন্দোলনকে শাহবাগ ইতিমধ্যে অতিক্রম করে ফেলেছে। শাহবাগ ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে পথ দেখাবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। জামায়াত শাহবাগের বিপক্ষে যাবে_ এটা ঐতিহাসিক স্বতঃসিদ্ধ। কেননা, জামায়াত ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ছিল; ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে ছিল। ঐতিহাসিকভাবেই জামায়াত প্রগতি, মুক্তি সংগ্রাম, নারী অধিকারের বিরুদ্ধে। কিন্তু শাহবাগ আন্দোলনের বিপক্ষে গিয়ে বিএনপি কেন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিল, তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। বিএনপি ১৯৭৫ সালের পর থেকে জামায়াত-শিবির ও রাজাকারদের পুনর্বাসন করার যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব নিয়েছে, হয়তো সেখান থেকে তারা এখনও বেরিয়ে আসতে পারেনি। অথবা বিএনপি রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া বলেই তাকে বারবার জামায়াত-শিবিরের এজেন্ডা বাস্তবায়নে আত্মঘাতী হতে হয়। তবে প্রজন্ম চত্বরের কর্মী ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকেও অনেক অনেক সতর্ক হতে হবে। মনে রাখতে হবে, ১৯৭১ সাল আর ২০১৩ সাল এক নয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে মাঠে-ময়দানে যেমন সংগ্রাম করতে হবে, ট্রাইব্যুনালে আইনি লড়াইও চালাতে হবে। মিডিয়া ও আন্তর্জাতিক নানা অঙ্গনেও তাদের কার্যকরভাবে সংগ্রাম করতে হবে। পরিশেষে দৃঢ়তার সঙ্গে এ কথা বলতে পারি যে, '৫২ যেমন '৭১ সৃষ্টি করে কিংবদন্তি হয়েছিল, ২০১৩-এর শাহবাগও তেমনি '৭১-এর মতো আরেক প্রমিথিউস সৃষ্টি করবে।
শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন :ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক আখতারুজ্জামান আজাদ ও ওমর হাসান আল জাহিদ : ব্লগগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন