মুহম্মদ জাফর ইকবাল
ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ তারিখ আমি শাহবাগের মঞ্চে ছিলাম—আহামরি কোনো মঞ্চ নয়,
একটি খোলা ট্রাক কিন্তু সেটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে অভূতপূর্ব ঘটনাগুলোর
একটি। যেদিকে তাকাই সেদিকেই মানুষ—আমি এর আগে কখনো কোনো মঞ্চ থেকে একসঙ্গে
এত মানুষ দেখিনি। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয়টি ছিল আমার বুকের ভেতরের অনুভূতি যে
এই মানুষগুলো বয়সে তরুণ, এরা সবাই আমার আপনজন, সারা জীবন আমি যে স্বপ্ন
দেখে এসেছি, এই তরুণেরা সবাই সেই স্বপ্ন দেখে।
সেই মঞ্চে মাথায় হলুদ ফিতে বাঁধা ব্লগাররা ছিল, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর আমার কোনো ভাষা ছিল না, তাই একজন একজন করে তাদের সবাইকে আমি বুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। মঞ্চে দাঁড়িয়ে অগণিত তরুণ-তরুণীর দিকে তাকিয়ে আমি আমার বুকের ভেতর একধরনের শক্তি অনুভব করেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, সারা জীবন আমি বুভুক্ষের মতো যে জিনিসটির জন্য অপেক্ষা করেছিলাম, তার সবটুকু এখানে পেয়ে গেছি। যে স্বপ্নটি দেখতে পর্যন্ত দ্বিধা করতাম, তার থেকে শতগুণ বেশি কেউ আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে।
আমি একটি প্রজন্ম চেয়েছিলাম, যারা এই দেশটিকে ভালোবাসবে। দেশটি যখন তার সব দুঃখ-কষ্ট পেছনে ফেলে মাথা তুলে দাঁড়াবে, শুধু তখন তাকে ভালোবাসবে তা নয়। দেশটি যখন দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত হবে তখনো ভালোবাসবে, অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি, দারিদ্র্যে যখন ক্ষতবিক্ষত হবে, তখনো গভীর মমতায় দেশটিকে বুকে আগলে রাখবে। আমি স্বপ্ন দেখতাম সেই ভালোবাসাটুকু আসবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে। নতুন প্রজন্ম শুধু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আর তথ্যের মধ্যে নিজেদের আটকে রাখবে না, সেটি শুধু দিন-তারিখ-নাম আর পরিসংখ্যান হবে না, তারা মুক্তিযুদ্ধকে বুকের মধ্যে ধারণ করবে। আমি ভেবেছিলাম, আমার এই স্বপ্ন আসলে কখনো পূরণ হওয়ার নয়। সারা পৃথিবীর সব তথ্য এখন সবার হাতের মুঠোয়, বাইরের জগতের উচ্ছ্বাস-উদ্দাম তারুণ্যের ছবি নিশ্চয়ই আমাদের তরুণদের মোহগ্রস্ত করে রাখবে। আমি ভেবেছিলাম, একাত্তর তাদের কাছে হবে বড়জোর ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আমাদের প্রজন্ম যে তীব্র আবেগ নিয়ে একাত্তরকে বুকে ধারণ করে নতুন প্রজন্ম কখনো সেটি করবে না, করার কথা নয়।
কিন্তু আমি অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করেছি, এই নতুন প্রজন্ম গভীর ভালোবাসায় একাত্তরকে বুকের গভীরে স্থান দিয়েছে। তারা একাত্তর দেখেনি, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব কিংবা আত্মত্যাগও দেখেনি। হাতে সঠিক অস্ত্র নেই, গায়ে কাপড় নেই, পেটে খাবার নেই, তার পরও রাইফেলের কালো নলে চিবুক স্পর্শ করে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রিগারে আঙুল দিয়ে শতগুণ শক্তিশালী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দিকে অস্ত্র তাক করে থাকতে দেখেনি। গ্রেনেডের পিন খুলে গাছের ডালে পাতার আড়ালে লুকিয়ে থেকে সাহসী তরুণদের মিলিটারি কনভয়ের জন্য অপেক্ষা করতে দেখেনি। রাজাকারদের হাতে ধরা পড়া গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা অত্যাচার জর্জরিত ক্ষতবিক্ষত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখেনি। জল্লাদখানায় পাকিস্তানি মিলিটারিদের একটি একটি করে নখ উপড়ে নিতে দেখেনি। ঘরের ভেতর যখন পাকিস্তানি মিলিটারি স্ত্রীকে ধর্ষণ করছে, তখন বাইরে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকা স্বামীকে দেখেনি। ক্যাম্পের ভেতর ধরে নেওয়া তরুণীকে দেখেনি, রাস্তায় উবু হয়ে বসে থাকা তার ব্যাকুল বাবাকে দেখেনি। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে অমিত তেজের কিশোরকে জয় বাংলা স্লোগান দিতে দেখেনি। তার পরও এই তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধকে অনুভব করতে পেরেছে। একটা জাতির জন্য এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে? সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার আর কিছু চাওয়ার নেই।
২.
আমাদের এই নতুন প্রজন্ম শুধু যে মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশকে ভালোবাসে তা নয়, তারা অনেক আধুনিক এবং তারা অনেক লেখাপড়া জানা ছেলেমেয়ে। তারা কোনো ধরনের প্রযুক্তিকে ভয় পায় না এবং বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে। তাদের ভেতর আবেগ আছে এবং সেটা প্রকাশ করতে তাদের দ্বিধা নেই, কিন্তু যখন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তখন তারা আবেগটা সরিয়ে রেখে যুক্তিতর্ক দিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। তারা সৎ, আত্মবিশ্বাসী এবং তাদের অসাধারণ কমনসেন্স। হঠাৎ করে তারা রাতারাতি গড়ে ওঠেনি, তারা নিশ্চয়ই অনেক দিন থেকেই নিজেদের মতো করে গড়ে উঠছিল, আমাদের মতো মানুষের চোখে পড়েছে হঠাৎ করেই। মনে আছে, যুদ্ধাপরাধীর বিচার বন্ধ করার জন্য জামায়াত-শিবির অনেক দিন থেকেই পুলিশের সঙ্গে পথেঘাটে মারামারি করছে। তার মাঝে হঠাৎ একদিন দেখা গেল, মতিঝিলে তাদের সঙ্গে পুলিশের একধরনের ভালোবাসার সম্পর্ক হয়ে গেছে। জামায়াত-শিবির রীতিমতো ফুল দিয়ে পুলিশকে বরণ করে নিচ্ছে। দেশের মানুষ তখনই ভুরু কুঁচকে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করতে শুরু করে। মতিঝিলের সেই সভায় জামায়াত প্রথম সদম্ভে দেশে গৃহযুদ্ধের একটা হুমকি দিল, নিজের কানে শুনেও সেটা বিশ্বাস হয় না। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা ৩৪৪ জন মানুষ হত্যায় দোষী সাব্যস্ত হয়েও সর্বোচ্চ শাস্তি না পাওয়ার ঘোষণাটি ছিল হতাশার, সেই হতাশাটি অবিশ্বাস্য ক্ষোভে পরিণত হলো যখন দেখা গেল শাস্তির রায় শুনে বিজয়ের ঘোষণা দেওয়ার জন্য কাদের মোল্লার হাতে ভি সাইন উঠে এসেছে। এত দিন থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য এত প্রস্তুতি, এত অপেক্ষা, সেই বিচারের রায় শুনে যুদ্ধাপরাধীরা যদি নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করতে শুরু করে, তাহলে দেশের মানুষ তো বিচারের পুরো প্রক্রিয়াটি নিয়ে বিভ্রান্ত হতেই পারে। সঠিক রায় দেওয়ার জন্য দেশকে প্রস্তুত করার প্রয়োজন মনে হতেই পারে।
আমাদের নতুন প্রজন্ম, সেই দুঃসময়ে পথে নেমে এসেছিল। বিষয়টি ছিল পুরোপুরি স্বতঃস্ফূর্ত, কোথায় কী হচ্ছে না জেনেও দেশের অনেক জায়গার মতো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছেলেমেয়ে প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে বের হয়ে গিয়েছিল। এর পরের ঘটনা আমরা সবাই জানি, শাহবাগের বিক্ষোভ সমাবেশটি দেখতে দেখতে শান্তিপূর্ণ এবং পুরোপুরি অহিংস কিন্তু প্রবলভাবে তারুণ্যের শক্তিতে ভরপুর একটা গণজাগরণের রূপ নিয়ে নিল। কত দিন এই আন্দোলন চলবে, কে নেতৃত্ব দেবে, আন্দোলনটি কেমন করে শেষ হবে, এসব বিষয় নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ ছিল না। এখনো শেষ হয়নি। কিন্তু আমার ধারণা, দেশের ক্রান্তিকালে যে এত দিন চোখের আড়ালে থাকা দেশের তরুণেরা নেতৃত্ব দিতে পারে, সাধারণ মানুষ এত দিনে সেটা মেনে নিয়েছে।
৩.
গণজাগরণ মঞ্চের এই নতুন কালচারটা শুরু হওয়ার পর সময় পেলেই আমি সেখানে গিয়ে বসে থাকি—সেটা ঢাকাতেই হোক আর সিলেটেই হোক। পুরো ব্যাপারটা তরুণদের, তার মধ্যে মাথায় পাকা চুল নিয়ে আমার সেখানে হাজির হতে খানিকটা যে সংকোচ হয় না তা নয়, তাই সব সময়ই চোখের কোনা দিয়ে খুঁজতে থাকি আমার বয়সী আর কেউ আছে কি না। খোঁজাখুঁজি করলে পাওয়া যায়, অনেকেই থাকেন—তাঁদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা আছেন, শহীদ পরিবারের লোকজন আছেন, আমার মতো অতি উৎসাহীরা আছেন, বয়স্ক মহিলারা থাকেন। আমি বেশ অবাক হয়ে আবিষ্কার করেছি, এ রকম একটি সমাবেশে আমি দীর্ঘ সময় বসে থাকতে পারি এবং আমি এর প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করি। এখানে গান হয়, বক্তৃতা হয়, স্মৃতিচারণা হয় এবং সবচেয়ে বেশি যেটা হয়, সেটা হচ্ছে স্লোগান। আমাদের দেশের তরুণদের মতো স্লোগান পৃথিবীর আর কোথাও দেওয়া হয় কি না এবং দেওয়া হলেও সেটা এ রকম প্রাণবন্ত হয় কি না, সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। কিছু কিছু স্লোগান যে আমার মতো মানুষের জন্য যথেষ্ট বিব্রতকর নয় তা নয়—কিন্তু বেশির ভাগ স্লোগানই এককথায় অপূর্ব। সেগুলোর শব্দচয়ন, বাক্যগঠন, রসবোধ এবং ছন্দের কোনো তুলনা নেই। আমি এই ধরনের সমাবেশে বসে শুধু যে স্লোগানের বক্তব্য শুনি তা নয়, স্লোগান দেওয়ার ভঙ্গিটাও প্রবলভাবে উপভোগ করি। পুরোপুরি গলা ভেঙে গেছে, গলা থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না, তার পরেও একজন পুরো শরীর কাঁপিয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে স্লোগান ধরছে এবং অন্যরা তার মুখ থেকে স্লোগানটি বুঝে পাল্টা প্রতিস্লোগান দিচ্ছে, এ রকম বিচিত্র দৃশ্য পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যাবে বলে মনে হয় না। বোরকা কিংবা হিজাব পরা যে মেয়েটিকে এত দিন লাজুক কিংবা শান্ত জেনে এসেছি, তার কণ্ঠ থেকে বজ্রনিনাদ শুনে বুঝতে পেরেছি, এত রক্তে অর্জন করা দেশটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটুকু নিয়ে তার বুকে কী গভীর একটা ক্ষোভ এত দিন লুকিয়ে ছিল।
নতুন প্রজন্মের এই স্লোগানগুলোর ভেতর দিয়ে দেশের জন্য গভীর ভালোবাসা, মুক্তিযুদ্ধের জন্য তীব্র আবেগ আর যুদ্ধাপরাধীদের জন্য ভয়ংকর ঘৃণা ফুটে ওঠে, কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে এই নতুন প্রজন্মের দেশ নিয়ে নিজস্ব স্বপ্নটুকুও আমাদের কাছে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। তারা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চায়, ছেলে-মেয়ের সমান অধিকার চায়, ধনী-গরিবের বিভাজন দূর করতে চায়। একাত্তরে যেটি ঘটেছিল, এখানেও ভিন্ন মাত্রায় সেটি ঘটতে শুরু করেছে, সবার ভেতর ভালো হওয়ার চেষ্টা, অন্যের জন্য মমতা, সহনশীলতা, শ্রদ্ধাবোধ একটি বিস্ময়কর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। (স্কুটারওয়ালার কাছে ভাংতি টাকা নেই বলে তাকে একজন মোবাইল টেলিফোন নম্বর দিয়ে চলে এসেছে, স্কুটারওয়ালা সেই নম্বরে টাকা ফ্লেক্সিলোড করে দিয়েছে) আমি লক্ষ করেছি, এই সমাবেশগুলোতে কোনো ইভ টিজিং নেই—যে মেয়েরা ব্যান্ড শুনতে যেতে ভয় পায়, তারা বিন্দুমাত্র শঙ্কা ছাড়া এখানে বসে থেকে স্লোগান দেয়। এই সবকিছুর সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছে সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হচ্ছে, জয় বাংলা স্লোগানের প্রত্যাবর্তন। মুক্তিযুদ্ধের এই স্লোগান হিসেবে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। প্রায় ৪০ বছর পর এটা আবার সব মানুষের স্লোগান হয়ে ফিরে এসেছে। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্মের মানুষ, তাদের জন্য এটি যে কত বড় একটি উপহার, সেটি কোনো দিন কাউকে বোঝাতে পারব না।
৪.
আমি যখন এ লেখাটি লিখছি, তখন সারা দেশে একধরনের তাণ্ডব চলছে, ভয়াবহতার ধাক্কাটা একটু কমেছে কিন্তু শেষ হয়নি। আমার একজন ছাত্র (সম্ভবত হিন্দু ধর্মাবলম্বী) যখন প্রথম শুকনো মুখে বেশ কিছুদিন আগে আমার কাছে জানতে চেয়েছিল, দেশে কি এখন হিন্দু-মুসলমান ‘রায়ট’ শুরু হয়ে যাবে? তখন তার কথা আমি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, এখানে হিন্দু আর মুসলমানদের মধ্যে কিছু নেই, শুধু শুধু তাদের মধ্যে দাঙ্গা হবে কেন? বোঝাই যাচ্ছে, আমি জামায়াত-শিবিরের কাজের ধরন সম্পর্কে কিছুই জানি না, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করার দাবিতে তারা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর আক্রমণ শুরু করে দিল। গোলমালকে জিইয়ে রাখার অনেক পুরোনো পদ্ধতি, আশপাশের মুসলমানদের ধারণা দেওয়া হয়, তোমাদের কোনো ভয় নেই, আমরা বেছে বেছে শুধু হিন্দুদের ধ্বংস করব। একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যা যা করেছিল, এত দিন পর আবার হুবহু সেই কাজগুলো করা হচ্ছে। হিন্দুদের ঘরবাড়ি, মন্দির, উপাসনালয় পুড়িয়ে দেওয়া তো আছেই, তার সঙ্গে আছে আওয়ামী লীগ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ধ্বংস করা, জাতীয় পতাকার অবমাননা করা। শুধু তা-ই নয়, এই কাজগুলো করার জন্য যখন প্রয়োজন ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে (অবলীলায় একজনকে নাস্তিক, মুরতাদ বলা হচ্ছে) কিংবা মিথ্যাচার করা হচ্ছে (চাঁদে যুদ্ধাপরাধীর চেহারা দেখা যাচ্ছে বলে ঘোষণা করা হচ্ছে)। হরতাল হচ্ছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, অফিস-আদালত পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, পদ্মা সেতু নিয়ে এ দেশে এত হইচই অথচ খবরের কাগজে দেখছি যত সম্পদ নষ্ট হয়েছে, সেটা দিয়ে একটা পদ্মা সেতু তৈরি হয়ে যেত। একজন মানুষের প্রাণ পদ্মা সেতু থেকে অনেক বেশি, সেই মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। প্রাণটি একজন পুলিশ, নিরীহ পথচারী, রাজনৈতিক কর্মী কিংবা জামায়াত-শিবিরের সমর্থক হোক না কেন, প্রত্যেকেরই সেটি সমান বেদনাদায়ক। পূর্ণ বয়স্ক একজন মানুষের মৃত্যুই আপনজনেরা মেনে নিতে পারে না আর এ রকম মৃত্যুগুলো মেনে নেওয়ার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। সারা দেশ নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছে কখন এই তাণ্ডব বন্ধ হবে—মৃত্যু নিয়ে রাজনীতির চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে? আগে দেশে একটি অলিখিত আইন ছিল—ছোট ছেলেমেয়েদের বড় পরীক্ষাগুলোতে হরতাল দেওয়া হবে না, এবার সেই আইনটিকে যে শুধু অমান্য করা হলো তা নয়, মনে হলো এখন থেকে সেটাই বুঝি নিয়ম, এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষা বন্ধ করে লেখাপড়ার সর্বনাশ করাতেই বুঝি গৌরব।
বাংলাদেশের মানুষ এর চেয়েও অনেক খারাপ অবস্থা থেকে বের হয়ে এসেছে। আমরা জানি, এবারের এই অস্থিরতা থেকেও বের হয়ে আসবে। সে জন্য কত দিন অপেক্ষা করতে হবে, আমাদের কতখানি ধৈর্য ধরতে হবে এবং সবচেয়ে বড় কথা কতখানি ত্যাগ স্বীকার করতে হবে, সেটা আমরা জানি না।
শুধু একটা বিষয় জানি, এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব এই দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রক্ষা করা। উনিশ শ একাত্তরে আমি দেখেছি একজন হিন্দু মা তার শিশুসন্তানকে বুকে চেপে ধরে উদ্ভ্রান্তের মতো তাঁর স্বামীর হাত ধরে ছুটে যাচ্ছেন, এত দিন পর এই দেশে আবার এই ঘটনা ঘটবে আর আমরা সেটা শুধু তাকিয়ে দেখব? আমি নিজেকে একটা হিন্দু পরিবারের ছোট একটি শিশু হিসেবে কল্পনা করে দেখেছি, তাদের মূল অনুভূতিটি হচ্ছে অবর্ণনীয় আতঙ্কের, অসহায় বোধ এবং তীব্র হতাশার। সবচেয়ে বড় অনুভূতিটা হচ্ছে এই দেশের ওপর, দেশের মানুষের ওপর রাগ, দুঃখ বা ক্ষোভ নয়, একটি গভীর অভিমানে একটা দেশ বা দেশের মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় লজ্জা আর কী হতে পারে?
৫.
গণজাগরণ মঞ্চ থেকে এই দেশের তরুণেরা একটা আন্দোলন শুরু করেছে। এই আন্দোলনটি কীভাবে শেষ হবে, এর সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা কীভাবে ঠিক করা হবে, সেসব নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। দেশের গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরা অনেক সময় এই তরুণদের নিয়ে দুর্ভাবনা করেন, তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা করেন, আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন।
কী কারণ জানা নেই, আমার কোনো দুশ্চিন্তা নেই। আমার যেটুকু পাওয়ার ছিল আমি সেটা পেয়ে গেছি। আমি সব সময় স্বপ্ন দেখেছিলাম, এই দেশে একটি তরুণ প্রজন্ম হবে, যারা মুক্তিযুদ্ধকে অনুভব করবে আর মুক্তিযুদ্ধে পাওয়া এই দেশটিকে ভালোবাসবে—আমার সেই স্বপ্ন এর মধ্যেই সফল হয়েছে, আমার আর কিছু চাওয়ার নেই।
কেউ যদি আঙুলে গুনে গুনে প্রাপ্তি হিসাব করতে চায়, সেটিও কি কম? কেউ কি ভেবেছিল দুই সপ্তাহের ভেতর আইন পাল্টে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ তৈরি হবে? শুধু আলাদা আলাদা মানুষ নয়, রাজনৈতিক দলটিরও বিচার করা সম্ভব হবে? এই দেশে জামায়াত-শিবির একটি আতঙ্কের আবহ তৈরি করে রেখেছিল। এখন কি এই দেশে ছোট একটা শিশুও অবলীলায় তাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয় না? গণজাগরণের সভায় ককটেল ফাটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে পুরো সভাকে কি ভন্ডুল করা গেছে? বিপদের ঝুঁকি নিয়েও কি তরুণ-তরুণীরা শান্তভাবে বসে থাকেনি? তাদের মনোবল শতগুণ বেড়ে যায়নি? জামায়াতে ইসলামীর বড় শক্তি হচ্ছে তাদের অর্থনৈতিক শক্তি। ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স, স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, হাসপাতাল, কোচিং সেন্টার, পরিবহন, দোকানপাট—কী নেই তাদের? গণজাগরণ মঞ্চের এই আন্দোলন কি এই পুরো অর্থনৈতিক কাঠামোর ভিত্তি বাড়িয়ে দেয়নি? পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে তাদের কি এখন সাফাই গাইতে হচ্ছে না? আমাদের দেশের অর্ধেক হচ্ছে মেয়ে। আমরা জীবনের সব জায়গায় ছেলেমেয়েদের সমানভাবে দেখি না। এই আন্দোলনে ছেলেরা আর মেয়েরা কি সমানভাবে পথে নেমে আসেনি?
এই তালিকা আরও অনেক লম্বা করা সম্ভব, আমি তার চেষ্টা করেছি না। কারণ, আমার হিসাবে দেশের তরুণদের মূল অর্জনের তুলনায় এগুলো সব ছোটখাটো অর্জন। তাদের মূল অর্জন হচ্ছে এই দেশের তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নকে বুকের গভীরে নিয়ে যাওয়া। এই প্রজন্ম এই মুহূর্তে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে পথে নেমেছে—কেউ কি ভাবছে যুদ্ধাপরাধীর বিচার শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা উদ্দেশ্যবিহীন হতোদ্যম কিছু তরুণ-তরুণীতে পাল্টে যাবে? মোটেও না, আমি লিখে দিতে পারি, তখন তারা অন্য কোনো আন্দোলনে পথে নামবে—হয়তো দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন, হয়তো গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন, অশিক্ষা-কুশিক্ষার বিরুদ্ধে আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতা দূর করার আন্দোলন, নারী-পুরুষের সমান অধিকারের আন্দোলন।
সব আন্দোলনই পথে বসে স্লোগান দিয়ে হয় না, অনেক আন্দোলন হবে লেখালেখি করে, গবেষণা করে, গ্রামে-গঞ্জে ঘুরেফিরে। অবসর সময়ে এই তরুণেরা হয়তো প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে স্কুলে পড়াবে, তরুণ ডাক্তারেরা বস্তিতে বাচ্চাদের চিকিৎসা করবে। তরুণ কবিরা কবিতা লিখবে, নাট্যকারেরা নাটক তৈরি করবে, চিত্রশিল্পী ছবি তৈরি করবে। একাত্তরের পরে আমাদের একটা রেনেসাঁ শুরু হয়েছিল, পঁচাত্তরে নির্মমভাবে সেটাকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমি স্বপ্ন দেখি আমাদের এই তরুণেরা সেই অসমাপ্ত রেনেসাঁ আবার শুরু করবে। স্বাধীনতার পরপর আমাদের অনেক শখ ছিল, সাধ্য ছিল না। এই তরুণদের শখ আর সাধ্য দুটোই আছে। আমরা তাদের সৃজনশীলতার ছোঁয়া দেখতে শুরু করেছি। কিছুদিন আগেও যদি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা আমাকে বলত, ‘স্যার, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু থেকে শেষ পুরো দুই কিলোমিটার পথ ক্যানভাসের মতো রঙিন ছবি দিয়ে ভরে ফেলব।’ আমি নিশ্চিত তাদের বলতাম, তোমাদের নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়েছে, তাই এ রকম অবাস্তব কথা বলছ। আমি এবার তাদের সেই কথা বলিনি আর সত্যি সত্যি শত শত ছেলেমেয়ে মিলে রাত-দিন খেটে দুই কিলোমিটার পথকে অপূর্ব একটি শিল্পকর্মে পাল্টে দিয়েছে। এই উৎসাহ, এই প্রেরণা এত দিন কোথায় লুকিয়ে ছিল?
আমি সুযোগ পেলেই নতুন প্রজন্মকে বলতাম, আমাদের প্রজন্ম তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। তারা মুক্তিযুদ্ধ করে তোমাদের একটি দেশ উপহার দিয়েছে। তাদের দায়িত্ব শেষ—এখন তোমাদের বাকি দায়িত্ব নিতে হবে। তাদের হাতে এখনো পুরোপুরি দায়িত্বটুকু যায়নি কিন্তু আমি জানি, তারা পুরোপুরি প্রস্তুত।
আমি সেটা কেমন করে জানি? কিছুদিন আগে ছোট একটা মেয়ে আমার কাছে চিঠি পাঠিয়েছে। সেই চিঠিতে তার দেশের জন্য গভীর ভালোবাসার কথা। এত ছোট একটা মেয়ে তার দেশকে এত তীব্রভাবে ভালোবাসতে পারে দেখে আমার চোখ ভিজে আসে। চিঠির শেষে সে আমাদের জাতীয় সংগীতটির প্রথম লাইনটি এভাবে লিখেছে: আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় অনেক অনেক অনেক ভালোবাসি।
আমাদের প্রজন্ম সোনার বাংলাকে শুধু ভালোবেসেছে—এই নতুন প্রজন্ম অনেক অনেক অনেক ভালোবাসে।
আমি যদি এই প্রজন্ম নিয়ে স্বপ্ন না দেখি, তাহলে কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখব?
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক। অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
Souece: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2013-03-16/news/336823
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন