মুনতাসীর মামুন
কীভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত ও প্রতারিত করতে হবে তা শেখা
দরকার প্রথমে জামায়াত এবং তারপর বিএনপির কাছ থেকে। জামায়াত এখন চুরিচামারি
করে যা রোজগার করে, এ ধরনের কোন স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয় খুললে আরও ভাল
রোজগার করবে। ১৯৭৫ সালের পর থেকে এ দেশের মানুষের মানসজগত বা মানসিক গড়নের
পরিবর্তন হয়েছে। গত ৩০ বছর প্রায় একটানা এ দেশ শাসিত হয়েছে খুনী প্রতারকদের
দ্বারা। তারা এমন একটি জেনারেশন তৈরি করতে পেরেছে যারা বিভ্রান্ত করতে ও
হতে এবং প্রতারণা করতে ও প্রতারিত হতে পছন্দ করে। আর এসব কিছু তারা করে
ইসলামের নামে। এই টাইপের লোকদের বিদ্যাবুদ্ধি স্থবির। যাদের খানিকটা ঝোঁক
ছিল বিএনপি-জামায়াতের প্রতি তারা এখন মুখে কিছু না বললেও প্রমাদ গুনছে।
কারণ ধর্মকে জামায়াত-বিএনপি অধর্ম বানিয়ে ছাড়ছে। এদের মধ্যে মানুষের কোন
গুণাবলী আর নেই।
ভিটামিন এ-র ঘটনাটা ধরা যাক। এ ভিটামিন বাংলাদেশের লাখ লাখ শিশুকে বাঁচাবে। জামায়াতের একটি ফ্রন্ট রোহিঙ্গা জঙ্গীরা সেই কক্সবাজারের মসজিদ থেকে ঘোষণা করল, ভিটামিন এ খেয়ে শিশু মারা যাচ্ছে। মোবাইল ফোনের কল্যাণে তা ছড়িয়ে দেয়া হলো। লাখ লাখ শিশুকে ক্যাপসুল খাওয়ান হলো না। এ কাজটি জামায়াত করল সরকারকে অপদস্থ করতে। সরকার কি ক্ষতিগ্রস্ত হয়? লাখ লাখ শিশু এখন রোগাক্রান্ত হবে বেকুব কিছু অভিভাবকের জন্য। এমনকি ডেইলি স্টারও অভিযোগ তুলেছে, তাদের পুরনো ছবি নতুনভাবে জামায়াতীরা ইন্টারনেটে ব্যবহার করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে ভিটামিন-এ খেয়ে শিশু মারা গেছে। এই হচ্ছে জামায়াত। লাখ লাখ শিশু মারা গেলেও যাদের কিছু আসে-যায় না।
দৈনিক প্রথম আলোয় একটি সংবাদ দেখলাম যার শিরোনাম- ‘মুনতাসীর মামুনের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে দ- দেয়া যাবে না।’ অর্থাৎ গোলাম আযমকে। সংবাদটি পড়ে মনে হতে পারে আমার ‘বিভ্রান্তিকর’ সাক্ষ্যের জন্য যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম ছাড়া পেয়ে যাচ্ছেন। গোলাম আযমের আইনজীবীরা আমার সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বলেছেন- “জেরায় আসামিপক্ষের নানা প্রশ্নের জবাবে মুনতাসীর মামুন ২১৩ বার ‘আমার জানা নেই’, ‘বলতে পারব না’, ‘কাগজপত্র না দেখে বলতে পারব না’, ‘আমি এটা দেখার প্রয়োজন বোধ করিনিÑ’ এ ধরনের কথা বলেছেন। পাকিস্তান পিপলস পার্টির ....” অর্থাৎ একজন অজ্ঞ ব্যক্তিকে সাক্ষ্য দিতে বলা হয়েছে। আসামিপক্ষের প্রশ্ন, “তিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করেছেন অথচ এসব মৌলিক প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি। তিনি বলেন, যদি তাকে এসব প্রশ্নের উত্তর পড়ে বলতে হয় তিনি কী শিক্ষা দেবেন তার ছাত্রদের?” [১২.৩.১৩]
এটি পড়ে আমার মনে হলো আমি কী বলেছি তাতে না গিয়ে তিনি আমার ক্রেডিবিলিটি নাকচ করতে চেয়েছেন, অবশ্য তার দিক থেকে সেটি স্বাভাবিক।
আমি সাক্ষ্য দিতে গিয়েছিলাম ইতিহাসের একজন হিসেবে, সামগ্রিকভাবে গোলাম আযমের কমান্ড রেসপনসিবিলিটি প্রমাণ করতে। তিনি কয়জায়গায় ক’টা খুন করেছেন তার সাক্ষ্য দিতে নয়। আসামিপক্ষ বারবার ফৌজদারী বিষয়ক জটিলতায় আমাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন যাতে আমি ইচ্ছুক ছিলাম না। গোলাম আযমের স্ট্যাটাস কী ছিল ১৯৭১ সালে? নিছক খুনী? না, তা নয়। প্রথমত তিনি একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান ছিলেন, যে দল তার কমান্ডে চলত এবং যে দল ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো ক্রিমিনাল সংগঠনে পরিণত হয়েছিল। যেমনÑ ছাত্রসংঘ হয়ে গিয়েছিল আলবদর। এই ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যারা গণহত্যা সংগঠন করছিল তাদের সহযোগী ছিল। যে কারণে গোলাম আযম টিক্কা খান, ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বারবার বৈঠক করেছেন। রাজাকার, আলবদর বাহিনী ও শান্তি কমিটি গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। রাজাকার, আলবদররা নিয়মিত বেতন পেত পাকিস্তানীদের থেকে কিন্তু তাদের পলিটিক্যাল হেড ছিলেন গোলাম আযম। শান্তি কমিটির সক্রিয় সদস্য হিসেবে জামায়াতীদের নিয়ে তিনি কমিটি করেছেন। এবং দলীয়প্রধান হিসেবে জামায়াতীদের নির্দেশ দিয়েছেন এসব সংগঠন/বাহিনীতে ঢুকতে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিহত করতে, হত্যা করতে এবং গণহত্যা ও ধর্ষণ করে বাঙালীদের দমিত করতে। তিনি নিজে দাঁড়িয়ে দু-তিনটা খুন করেছেন কি না তা মূল বিষয় নয়। মূল বিষয় ৩০ লাখ হত্যা ও ৬ লাখ ধর্ষণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা, নির্দেশ দান ইত্যাদি। আমি প্রশ্নোত্তরের ধরনের কয়েকটি উদ্ধৃতি দিচ্ছিÑ
৪ জুলাই ২০১২ তারিখে আসামিপক্ষের জেরা এবং মুনতাসীর মামুনের জবাব
প্রশ্ন : পূর্ববঙ্গ বঞ্চনার শিকারের কথা বলেছেন আপনি। মোগল আমল থেকে ’৪৭ পর্যন্ত এ বঞ্চনা ছিল কি না।
উত্তর : মোগল আমল আমার গবেষণার বিষয় নয়। ’৪৭-এর পর পূর্ববঙ্গের প্রতি বঞ্চনার যে কথা আমি বলেছি তার কারণ হলো পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল এ অঞ্চলে সাম্য প্রতিষ্ঠা। সেটা হয়নি বলেই এটা এসেছে। বঞ্চনা পৃথিবীর শুরু থেকেই ছিল। পৃথিবীর শুরু থেকেই হ্যাভ এবং হ্যাভ নট-এর বঞ্চনা ছিল তা ’৪৭-পরবর্তী বঞ্চনার সঙ্গে তুলনীয় নয়।
প্রশ্ন : ’৪৭-এর আগে পূর্ববঙ্গের কতজন লোক ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কমিশন্ড অফিসার ছিল তার কোন তথ্য আছে আপনার কাছে?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : অনুরূপভাবে ভারতীয় সিভিল সার্ভিস ও বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে পূর্ববঙ্গের কতজন প্রথম শ্রেণীর অফিসার ছিল তার তথ্যও নেই আপনার কাছে?
উত্তর : নেই, কারণ ওটি আমার গবেষণার বিষয় নয়।
প্রশ্ন : ’৪৭-এর পূর্বে পূর্ববঙ্গে কোন পাটকল ছিল?
উত্তর : আমার জানামতে ছিল না।
প্রশ্ন : ’৪৭-এর পূর্বে পূর্ববঙ্গে কোন ভারি শিল্পের অস্তিত্ব ছিল না?
উত্তর : আমার জানার বিষয় নয় এটা।
প্রশ্ন : ১৯৪৬-এর নির্বাচনে এ অঞ্চলের যাঁরা মুসলমানদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হন তাঁরা কেউ জামায়াতে ইসলামীর ছিলেন না?
উত্তর : আমার জানামতে ছিল না।
প্রশ্ন : পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় কোন সময় জামায়াত ছিল না?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : ১৯৭১-পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় কখনও মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ এবং কখনও সামরিক বাহিনী ছিল?
উত্তর : মুসলিম লীগ, সামরিক বাহিনী ছিল। আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রন্টের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতায় ছিল।
প্রশ্ন : পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান যখন হয় তখন তাতে মতবিরোধ ছিল, না সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ হয়?
উত্তর : মতবিরোধ ছিল, তবে যখন সংসদে তা পাস হয় তখন সর্বসম্মতভাবেই পাস হয় ধরে নিতে হবে।
প্রশ্ন : যে পরিষদ কর্তৃক সংবিধান প্রণীত হয় তার অন্যতম সদস্য ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান?
উত্তর : হ্যাঁ।
প্রশ্ন : মৌলিক গণতন্ত্রের অধীনে প্রেসিডেন্ট থেকে পার্লামেন্ট পর্যন্ত সকল নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়।”
এ ধরনের জেরা কয়েক দিন চলে। যেমন, আরেক দিনের জেরার উদ্ধৃতিÑ
প্রশ্ন : শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে তখন যোগাযোগ ছিল?
উত্তর : নিয়মিত ছিল না, দু-একবার যোগাযোগ হয়।
প্রশ্ন : পরিবারের সদস্য ছাড়া নিয়মিত যোগাযোগ হয় এমন একটি নাম বলেন।
উত্তর : নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না।
প্রশ্ন : ওই সময় বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের পেশা কী ছিল?
উত্তর : খুব সম্ভবত ফার্মে চাকরি করতেন।
প্রশ্ন : অফিস কোথায় ছিল?
উত্তর : জানা নেই।
(এ পর্যায়ে মুনতাসীর মামুন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমি চুরি-ডাকাতির কেসে সাক্ষ্য দিতে আসিনি)।
প্রশ্ন : আপনার চাচা কিসে যাতায়াত করতেনÑ রিকশা, সাইকেল, না গাড়িতে?
উত্তর : বাসা থেকে বের হয়ে তিনি রিকশা না গাড়িতে যেতেন, তা বলতে পারব না।
প্রশ্ন : ওই এলাকার স্থানীয় লোকদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ছিল?
উত্তর : দুই-একজনের সঙ্গে ছিল।
প্রশ্ন : দু-একজনের নাম বলতে পারবেন?
উত্তর : বেবি মওদুদ। জাস্টিস মওদুদের মেয়ে। আমার চেয়ে সিনিয়র ছিলেন। তার সঙ্গে পরিচয় ছিল।
প্রশ্ন : ( বোঝা যায়নি)
উত্তর : আমি তখন প্রায়ই ঘরে থাকতাম। সে এলাকার (ধানম-ি) হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট হয়েছে কি না বলতে পারব না।
প্রশ্ন : ওই এলাকার এ বিষয়ে কোন খবরও আপনার গোচরীভূত হয়নি?
উত্তর : এটি সঠিক নয়। সংবাদপত্র, রেডিও মারফত জানতে পারতাম কোথায় কী হচ্ছে। তা ছাড়া বাসায় কোন অতিথি এলে, লোকজন এলে খবর পেতাম।
প্রশ্ন : ওই সময় ধানম-ি এলাকায় নিহত একজনের নাম বলেন।
উত্তর : স্মরণ নেই।
প্রশ্ন : ওই এলাকায় রেপের শিকার একজনের নাম বলেন।
উত্তর : স্মরণ নেই।
প্রশ্ন : অগ্নিংযোগ হয়েছে এ রকম একটি বাড়ির নাম বলেন।
উত্তর : বলতে পারব না।
প্রশ্ন : মিরপুর থেকে ২৯ মার্চ প্রথম কোথায় আসেন?
উত্তর : সোবহানবাগ।
এসব প্রশ্নের সঙ্গে গোলাম আযমের কমান্ড রেসপনসিবিলিটির কী সম্পর্ক? তিনি আমার বিদ্যাবুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সে বিষয়ে আর কী বলব। গত চল্লিশ বছর আমার ছাত্ররা বিচারপতি, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, সচিব, কী না হয়েছেন। তাঁরা যখন বিদ্যাবুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি তখন আসামি পক্ষের আইনজীবীদের এ ধারণা থাকলে তো আমার কিছু করার নেই। আমি যখন শিক্ষক তখন তারা স্কুলের ছাত্র কি না সন্দেহ। বিষয় সেটা নয়, তাদের প্রশ্নের ধরনই বলে দেয় তাদের বিদ্যাবুদ্ধির ধরন। বিচারকদের এবং সাধারণ মানুষদের বিভ্রান্ত বা প্রতারণা করার জন্য কোন বিষয়ের কোন ব্যাখ্যা দেয় সেটি মনে রাখা বাঞ্ছনীয়।
যেমন, চাঁদে সাঈদী নামাজ পড়ছে [নাউজুবিল্লাহ]। এ ধরনের ধর্মবিরোধী কথা বলে ধর্মের জিগির তুলে তারা বগুড়ার কিছু এলাকা তছনছ করে দিল। যারা এসব গুজব শুনে বেরিয়েছে তারা মানুষ হয় কীভাবে? ধার্মিক হওয়া তো দূরের। এই একটি ঘটনা প্রমাণ করে একুশ শতকে পৌঁছে এখানকার মানুষ এখনও পঞ্চদশ শতকে বসবাস করছে। আমরা একুশ শতকের মতো চিন্তা করে কতটুকু এগোতে পারব? জামায়াত এই বৈশিষ্ট্যটি চিহ্নিত করতে পেরে ভালভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
১৯৭১ সালে জামায়াত পাকিস্তানী বাহিনীর সহায়তায় কোরান পুড়িয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় মসজিদে জায়নামাজ পুড়িয়েছে। এদের যদি ধর্মপ্রাণ বলতে হয় এবং এদের যদি ধর্মের ঠিকাদারি দেয়া হয় তাহলে দেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। খালেদা জিয়াও এখন ইসলামী মূল্যবোধের ধারক! জামায়াতী ‘মৌলানারা’ তাই মনে করে। তাহলে বুঝুন, এই যদি ইসলামের বোধ বলে প্রচারিত হয় ও কিছু মানুষ তা সমর্থন করে সেখানে তো যুক্তির কোন প্রশ্ন আসে না। আমি কয়েকটি উদাহরণ দিই।
মসজিদ কী? খোদার কাছে আত্মসমর্পণের স্থান। বিভিন্ন হাদিস অনুসারে আমাদের প্রিয় নবী (স) যা বলতেন তাহলো ‘তোমরা কোন উপাসনালয় ভাঙবে না, কোন পুরোহিত, উপাসক, বৃদ্ধ, নারী ও শিশুকে বধ করবে না।’ গত দু’মাসে বিএনপি-জামায়াত মহানবীর (স) বাণীকে উপেক্ষা করে মন্দির ভেঙ্গেছে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ করতে গেছে।
আ. ত. ময়মনী লিখেছেন, কারও নাম বিকৃত করা বা মন্দ নামে ডাকা অনুচিত। এখন মওদুদীর শিষ্য পেশাদার বক্তা সাঈদী প্রতিটি মানুষের নাম বিকৃত করে কোরানকে উপেক্ষা করেছেন। আপনারা কীভাবে ভুলে গেলেনÑ এই সাঈদী জাহানারা ইমামকে বলত জাহান্নামের ইমাম, আহমদ শরীফকে বলতেন আহম্মক শরীফ। আহমদ আমাদের প্রিয় নবীর (স) দ্বিতীয় নাম। সি. আর. দত্তকে বলতেন শিয়াল দত্ত। এ রকম একটি নোংরা মনের লোককে এখন ‘আল্লামা’ বলা হয়, ‘মৌলানা’ বলা হয় তখন মনে হয় ইসলামের আর কত অবমাননা আমরা করব!
মওদুদীর কট্টর সমর্থক জামায়াতীরা যে দেশটিকে ধর্মের নামে অর্ধমের পথে নিয়ে যাচ্ছে তা তথাকথিত শিক্ষিতরাও কি বোঝেন না, নাকি বুঝে না বোঝার ভান করেন? তারা ধর্মের বিপরীতে অধর্মকে সমর্থন করে কি মনে করেন ধর্ম করছেন? আমাদের পুরনো কিছু পুস্তিকা থেকে প্রকৃত ইসলাম ও জামায়াতী ইসলামের পার্থক্য তুলে ধরছি (বন্ধনীতে যেসব বইয়ের নাম উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোর রচয়িতা মওদুদী)
* ইসলাম বলেছে, আল্লাহতায়ালা নির্যাতনমূলক কোন বিধান দেননি। জামায়াতীরা বলেছে, ব্যভিচারের শাস্তি রজম বা পাথর মারা, যা কি না নিঃসন্দেহে নির্যাতন। (তাফহিমাত, ২য় খ-, ২৮১ পৃষ্ঠা)
* ইসলাম বলেছে, ফেরেশতারা নূরের তৈরি আল্লাহর মখলুক। জামায়াতীরা বলেছে, ফেরেশতা প্রায় একই বস্তু যাকে ভারত, গ্রিক প্রতৃতি দেশের পৌত্তলিকরা দেবদেবী স্থির করেছে। (তাজদীদ ও এহইয়ায়ে দ্বীন, ১০ পৃষ্ঠা)
* ইসলাম বলেছে, নবী-রাসূলগণ নিষ্পাপ। তাঁরা কোন গুনাহ করেননি। জামায়াতীরা বলেছে, নবী রাসূলগণ নিষ্পাপ নন। প্রত্যেক নবীই গুনাহ করেছেন (তাফহিমাত, ২য় খ-, ৪৩ পৃষ্ঠা)
* জামায়াতীরা বলেছে, হযরত ইউনুস (আ) নবুয়াতের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেননি। (তাফহিমুল কোরান, ২য় খ-, ৯৯ পৃষ্ঠা)
* হযরত ইব্রাহিম (আ) ক্ষণিকের জন্য শিরক গুনাহে নিমজ্জিত ছিলেন। (তাফহিমুল কোরান, ১ম খ-, ৫৫ পৃষ্ঠা)।
* ইসলাম বলেছে, মহানবী (সা) মানবিক দুর্বলতামুক্ত ছিলেন। জামায়াতীরা বলেছে, মহানবী (সা) মানবিক দুর্বলতামুক্ত ছিলেন না। (তরজমানুল কোরান, ৮৫শ সংখ্যা, ২৩০ পৃষ্ঠা)।
* ইসলাম বলেছে, মহানবী (স) মনগড়া কোন কথা বলেননি। জামায়াতীরা বলেছে, মহানবী (স) মনগড়া কথা বলেছেন। নিজের কথায় তিনি নিজেই সন্দেহ করেছেন। (তরজমানুল কোরান, রবিউল আউয়াল, ১৩৫৬ হিজরী)
* ইসলাম বলেছে, সাহাবা কেরাম অনুসরণযোগ্য। জামায়াতীরা বলেছে, সাহাবাদের অনুসরণ করবে না। (দস্তরে জামায়াতে ইসলামী ৭ পৃষ্ঠা)
* জামায়াতীদের মতে হযরত আবুবকর (রা) দুর্বলমনা ও খেলাফতের দায়িত্ব বহনে অযোগ্য ছিলেন। (তাজদীদ ও এহইয়ায়ে দ্বীন, ২২ পৃষ্ঠা)।
* হযরত আলী (রা) খেলাফত আমলে এরূপ কিছু কাজ করেছেন, যা অন্যায় বলা ছাড়া উপায় নেই (খেলাফত ও মুলকিয়াত, ১৭৩ পৃষ্ঠা)।
* ইসলাম বলেছে, পবিত্র কোরানের মনগড়া ব্যাখ্যা করা হারাম। জামায়াতীরা বলেছে, কোরান মজিদের মনগড়া ব্যাখ্যা করা জায়েজ। (তরজমানুল কোরান, জমাদিউস সানি, ১৩৫৫ হি.)
* ইসলাম বলেছে, রোজাদারের জন্য সুবহে সাদেকের পর পানাহার করা নাজায়েজ। কেউ করলে রোজা হবে না। জামায়াতীরা বলেছে, রোজাদারের জন্য সুবহে সাদেকের পর আজান শুনলেও পানাহার করা বিলকুল জায়েজ। (তাফহিমুল কোরান, ১ম খ-, ১৪৬ পৃষ্ঠা)।
পবিত্র কোরান ও হাদিসের খেলাফ ও ধরনের আরও বহু কথা জামায়াতীরা তাদের বিভিন্ন পুস্তকে বলেছে। সুতরাং পবিত্র ইসলামের মুখোশধারী এই বাতিল ফেরকা থেকে নিজেকে এবং সন্তান-সন্ততিকে দূরে রাখুন। আল্লাহর ইবাদতের স্থান মসজিদকে জামায়াতীদের রাজনৈতিক আখড়ায় পরিণত করতে বারণ করুন এবং এই দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণার জন্য সরকারের কাছে দাবি তুলুন।
বিএনপিও এখন এই অধর্মকে সমর্থন করছে। সুতরাং ধর্মের কারণেও বিএনপিকে প্রতিরোধ করা বাঞ্ছনীয়। তবে সরকার বা ১৪ দলের ওপর নির্ভর করবেন না। যদি ধর্মে আস্থা থাকে এবং মনে করেন জামায়াত-বিএনপি অশুভ শক্তি এবং নিরপেক্ষরা এদের সহায়ক, তাহলে এই উদাহরণগুলো আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ছড়িয়ে দিন। দেশকে পঞ্চদশ শতক থেকে একুশ শতকে আনার চেষ্টায় শরিক হন। সেটিও পুণ্যের কাজ।
ভিটামিন এ-র ঘটনাটা ধরা যাক। এ ভিটামিন বাংলাদেশের লাখ লাখ শিশুকে বাঁচাবে। জামায়াতের একটি ফ্রন্ট রোহিঙ্গা জঙ্গীরা সেই কক্সবাজারের মসজিদ থেকে ঘোষণা করল, ভিটামিন এ খেয়ে শিশু মারা যাচ্ছে। মোবাইল ফোনের কল্যাণে তা ছড়িয়ে দেয়া হলো। লাখ লাখ শিশুকে ক্যাপসুল খাওয়ান হলো না। এ কাজটি জামায়াত করল সরকারকে অপদস্থ করতে। সরকার কি ক্ষতিগ্রস্ত হয়? লাখ লাখ শিশু এখন রোগাক্রান্ত হবে বেকুব কিছু অভিভাবকের জন্য। এমনকি ডেইলি স্টারও অভিযোগ তুলেছে, তাদের পুরনো ছবি নতুনভাবে জামায়াতীরা ইন্টারনেটে ব্যবহার করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে ভিটামিন-এ খেয়ে শিশু মারা গেছে। এই হচ্ছে জামায়াত। লাখ লাখ শিশু মারা গেলেও যাদের কিছু আসে-যায় না।
দৈনিক প্রথম আলোয় একটি সংবাদ দেখলাম যার শিরোনাম- ‘মুনতাসীর মামুনের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে দ- দেয়া যাবে না।’ অর্থাৎ গোলাম আযমকে। সংবাদটি পড়ে মনে হতে পারে আমার ‘বিভ্রান্তিকর’ সাক্ষ্যের জন্য যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম ছাড়া পেয়ে যাচ্ছেন। গোলাম আযমের আইনজীবীরা আমার সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বলেছেন- “জেরায় আসামিপক্ষের নানা প্রশ্নের জবাবে মুনতাসীর মামুন ২১৩ বার ‘আমার জানা নেই’, ‘বলতে পারব না’, ‘কাগজপত্র না দেখে বলতে পারব না’, ‘আমি এটা দেখার প্রয়োজন বোধ করিনিÑ’ এ ধরনের কথা বলেছেন। পাকিস্তান পিপলস পার্টির ....” অর্থাৎ একজন অজ্ঞ ব্যক্তিকে সাক্ষ্য দিতে বলা হয়েছে। আসামিপক্ষের প্রশ্ন, “তিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করেছেন অথচ এসব মৌলিক প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি। তিনি বলেন, যদি তাকে এসব প্রশ্নের উত্তর পড়ে বলতে হয় তিনি কী শিক্ষা দেবেন তার ছাত্রদের?” [১২.৩.১৩]
এটি পড়ে আমার মনে হলো আমি কী বলেছি তাতে না গিয়ে তিনি আমার ক্রেডিবিলিটি নাকচ করতে চেয়েছেন, অবশ্য তার দিক থেকে সেটি স্বাভাবিক।
আমি সাক্ষ্য দিতে গিয়েছিলাম ইতিহাসের একজন হিসেবে, সামগ্রিকভাবে গোলাম আযমের কমান্ড রেসপনসিবিলিটি প্রমাণ করতে। তিনি কয়জায়গায় ক’টা খুন করেছেন তার সাক্ষ্য দিতে নয়। আসামিপক্ষ বারবার ফৌজদারী বিষয়ক জটিলতায় আমাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন যাতে আমি ইচ্ছুক ছিলাম না। গোলাম আযমের স্ট্যাটাস কী ছিল ১৯৭১ সালে? নিছক খুনী? না, তা নয়। প্রথমত তিনি একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান ছিলেন, যে দল তার কমান্ডে চলত এবং যে দল ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো ক্রিমিনাল সংগঠনে পরিণত হয়েছিল। যেমনÑ ছাত্রসংঘ হয়ে গিয়েছিল আলবদর। এই ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যারা গণহত্যা সংগঠন করছিল তাদের সহযোগী ছিল। যে কারণে গোলাম আযম টিক্কা খান, ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বারবার বৈঠক করেছেন। রাজাকার, আলবদর বাহিনী ও শান্তি কমিটি গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। রাজাকার, আলবদররা নিয়মিত বেতন পেত পাকিস্তানীদের থেকে কিন্তু তাদের পলিটিক্যাল হেড ছিলেন গোলাম আযম। শান্তি কমিটির সক্রিয় সদস্য হিসেবে জামায়াতীদের নিয়ে তিনি কমিটি করেছেন। এবং দলীয়প্রধান হিসেবে জামায়াতীদের নির্দেশ দিয়েছেন এসব সংগঠন/বাহিনীতে ঢুকতে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিহত করতে, হত্যা করতে এবং গণহত্যা ও ধর্ষণ করে বাঙালীদের দমিত করতে। তিনি নিজে দাঁড়িয়ে দু-তিনটা খুন করেছেন কি না তা মূল বিষয় নয়। মূল বিষয় ৩০ লাখ হত্যা ও ৬ লাখ ধর্ষণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা, নির্দেশ দান ইত্যাদি। আমি প্রশ্নোত্তরের ধরনের কয়েকটি উদ্ধৃতি দিচ্ছিÑ
৪ জুলাই ২০১২ তারিখে আসামিপক্ষের জেরা এবং মুনতাসীর মামুনের জবাব
প্রশ্ন : পূর্ববঙ্গ বঞ্চনার শিকারের কথা বলেছেন আপনি। মোগল আমল থেকে ’৪৭ পর্যন্ত এ বঞ্চনা ছিল কি না।
উত্তর : মোগল আমল আমার গবেষণার বিষয় নয়। ’৪৭-এর পর পূর্ববঙ্গের প্রতি বঞ্চনার যে কথা আমি বলেছি তার কারণ হলো পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল এ অঞ্চলে সাম্য প্রতিষ্ঠা। সেটা হয়নি বলেই এটা এসেছে। বঞ্চনা পৃথিবীর শুরু থেকেই ছিল। পৃথিবীর শুরু থেকেই হ্যাভ এবং হ্যাভ নট-এর বঞ্চনা ছিল তা ’৪৭-পরবর্তী বঞ্চনার সঙ্গে তুলনীয় নয়।
প্রশ্ন : ’৪৭-এর আগে পূর্ববঙ্গের কতজন লোক ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কমিশন্ড অফিসার ছিল তার কোন তথ্য আছে আপনার কাছে?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : অনুরূপভাবে ভারতীয় সিভিল সার্ভিস ও বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে পূর্ববঙ্গের কতজন প্রথম শ্রেণীর অফিসার ছিল তার তথ্যও নেই আপনার কাছে?
উত্তর : নেই, কারণ ওটি আমার গবেষণার বিষয় নয়।
প্রশ্ন : ’৪৭-এর পূর্বে পূর্ববঙ্গে কোন পাটকল ছিল?
উত্তর : আমার জানামতে ছিল না।
প্রশ্ন : ’৪৭-এর পূর্বে পূর্ববঙ্গে কোন ভারি শিল্পের অস্তিত্ব ছিল না?
উত্তর : আমার জানার বিষয় নয় এটা।
প্রশ্ন : ১৯৪৬-এর নির্বাচনে এ অঞ্চলের যাঁরা মুসলমানদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হন তাঁরা কেউ জামায়াতে ইসলামীর ছিলেন না?
উত্তর : আমার জানামতে ছিল না।
প্রশ্ন : পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় কোন সময় জামায়াত ছিল না?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : ১৯৭১-পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় কখনও মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ এবং কখনও সামরিক বাহিনী ছিল?
উত্তর : মুসলিম লীগ, সামরিক বাহিনী ছিল। আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রন্টের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতায় ছিল।
প্রশ্ন : পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান যখন হয় তখন তাতে মতবিরোধ ছিল, না সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ হয়?
উত্তর : মতবিরোধ ছিল, তবে যখন সংসদে তা পাস হয় তখন সর্বসম্মতভাবেই পাস হয় ধরে নিতে হবে।
প্রশ্ন : যে পরিষদ কর্তৃক সংবিধান প্রণীত হয় তার অন্যতম সদস্য ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান?
উত্তর : হ্যাঁ।
প্রশ্ন : মৌলিক গণতন্ত্রের অধীনে প্রেসিডেন্ট থেকে পার্লামেন্ট পর্যন্ত সকল নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়।”
এ ধরনের জেরা কয়েক দিন চলে। যেমন, আরেক দিনের জেরার উদ্ধৃতিÑ
প্রশ্ন : শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে তখন যোগাযোগ ছিল?
উত্তর : নিয়মিত ছিল না, দু-একবার যোগাযোগ হয়।
প্রশ্ন : পরিবারের সদস্য ছাড়া নিয়মিত যোগাযোগ হয় এমন একটি নাম বলেন।
উত্তর : নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না।
প্রশ্ন : ওই সময় বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের পেশা কী ছিল?
উত্তর : খুব সম্ভবত ফার্মে চাকরি করতেন।
প্রশ্ন : অফিস কোথায় ছিল?
উত্তর : জানা নেই।
(এ পর্যায়ে মুনতাসীর মামুন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমি চুরি-ডাকাতির কেসে সাক্ষ্য দিতে আসিনি)।
প্রশ্ন : আপনার চাচা কিসে যাতায়াত করতেনÑ রিকশা, সাইকেল, না গাড়িতে?
উত্তর : বাসা থেকে বের হয়ে তিনি রিকশা না গাড়িতে যেতেন, তা বলতে পারব না।
প্রশ্ন : ওই এলাকার স্থানীয় লোকদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ছিল?
উত্তর : দুই-একজনের সঙ্গে ছিল।
প্রশ্ন : দু-একজনের নাম বলতে পারবেন?
উত্তর : বেবি মওদুদ। জাস্টিস মওদুদের মেয়ে। আমার চেয়ে সিনিয়র ছিলেন। তার সঙ্গে পরিচয় ছিল।
প্রশ্ন : ( বোঝা যায়নি)
উত্তর : আমি তখন প্রায়ই ঘরে থাকতাম। সে এলাকার (ধানম-ি) হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট হয়েছে কি না বলতে পারব না।
প্রশ্ন : ওই এলাকার এ বিষয়ে কোন খবরও আপনার গোচরীভূত হয়নি?
উত্তর : এটি সঠিক নয়। সংবাদপত্র, রেডিও মারফত জানতে পারতাম কোথায় কী হচ্ছে। তা ছাড়া বাসায় কোন অতিথি এলে, লোকজন এলে খবর পেতাম।
প্রশ্ন : ওই সময় ধানম-ি এলাকায় নিহত একজনের নাম বলেন।
উত্তর : স্মরণ নেই।
প্রশ্ন : ওই এলাকায় রেপের শিকার একজনের নাম বলেন।
উত্তর : স্মরণ নেই।
প্রশ্ন : অগ্নিংযোগ হয়েছে এ রকম একটি বাড়ির নাম বলেন।
উত্তর : বলতে পারব না।
প্রশ্ন : মিরপুর থেকে ২৯ মার্চ প্রথম কোথায় আসেন?
উত্তর : সোবহানবাগ।
এসব প্রশ্নের সঙ্গে গোলাম আযমের কমান্ড রেসপনসিবিলিটির কী সম্পর্ক? তিনি আমার বিদ্যাবুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সে বিষয়ে আর কী বলব। গত চল্লিশ বছর আমার ছাত্ররা বিচারপতি, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, সচিব, কী না হয়েছেন। তাঁরা যখন বিদ্যাবুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি তখন আসামি পক্ষের আইনজীবীদের এ ধারণা থাকলে তো আমার কিছু করার নেই। আমি যখন শিক্ষক তখন তারা স্কুলের ছাত্র কি না সন্দেহ। বিষয় সেটা নয়, তাদের প্রশ্নের ধরনই বলে দেয় তাদের বিদ্যাবুদ্ধির ধরন। বিচারকদের এবং সাধারণ মানুষদের বিভ্রান্ত বা প্রতারণা করার জন্য কোন বিষয়ের কোন ব্যাখ্যা দেয় সেটি মনে রাখা বাঞ্ছনীয়।
যেমন, চাঁদে সাঈদী নামাজ পড়ছে [নাউজুবিল্লাহ]। এ ধরনের ধর্মবিরোধী কথা বলে ধর্মের জিগির তুলে তারা বগুড়ার কিছু এলাকা তছনছ করে দিল। যারা এসব গুজব শুনে বেরিয়েছে তারা মানুষ হয় কীভাবে? ধার্মিক হওয়া তো দূরের। এই একটি ঘটনা প্রমাণ করে একুশ শতকে পৌঁছে এখানকার মানুষ এখনও পঞ্চদশ শতকে বসবাস করছে। আমরা একুশ শতকের মতো চিন্তা করে কতটুকু এগোতে পারব? জামায়াত এই বৈশিষ্ট্যটি চিহ্নিত করতে পেরে ভালভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
১৯৭১ সালে জামায়াত পাকিস্তানী বাহিনীর সহায়তায় কোরান পুড়িয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় মসজিদে জায়নামাজ পুড়িয়েছে। এদের যদি ধর্মপ্রাণ বলতে হয় এবং এদের যদি ধর্মের ঠিকাদারি দেয়া হয় তাহলে দেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। খালেদা জিয়াও এখন ইসলামী মূল্যবোধের ধারক! জামায়াতী ‘মৌলানারা’ তাই মনে করে। তাহলে বুঝুন, এই যদি ইসলামের বোধ বলে প্রচারিত হয় ও কিছু মানুষ তা সমর্থন করে সেখানে তো যুক্তির কোন প্রশ্ন আসে না। আমি কয়েকটি উদাহরণ দিই।
মসজিদ কী? খোদার কাছে আত্মসমর্পণের স্থান। বিভিন্ন হাদিস অনুসারে আমাদের প্রিয় নবী (স) যা বলতেন তাহলো ‘তোমরা কোন উপাসনালয় ভাঙবে না, কোন পুরোহিত, উপাসক, বৃদ্ধ, নারী ও শিশুকে বধ করবে না।’ গত দু’মাসে বিএনপি-জামায়াত মহানবীর (স) বাণীকে উপেক্ষা করে মন্দির ভেঙ্গেছে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ করতে গেছে।
আ. ত. ময়মনী লিখেছেন, কারও নাম বিকৃত করা বা মন্দ নামে ডাকা অনুচিত। এখন মওদুদীর শিষ্য পেশাদার বক্তা সাঈদী প্রতিটি মানুষের নাম বিকৃত করে কোরানকে উপেক্ষা করেছেন। আপনারা কীভাবে ভুলে গেলেনÑ এই সাঈদী জাহানারা ইমামকে বলত জাহান্নামের ইমাম, আহমদ শরীফকে বলতেন আহম্মক শরীফ। আহমদ আমাদের প্রিয় নবীর (স) দ্বিতীয় নাম। সি. আর. দত্তকে বলতেন শিয়াল দত্ত। এ রকম একটি নোংরা মনের লোককে এখন ‘আল্লামা’ বলা হয়, ‘মৌলানা’ বলা হয় তখন মনে হয় ইসলামের আর কত অবমাননা আমরা করব!
মওদুদীর কট্টর সমর্থক জামায়াতীরা যে দেশটিকে ধর্মের নামে অর্ধমের পথে নিয়ে যাচ্ছে তা তথাকথিত শিক্ষিতরাও কি বোঝেন না, নাকি বুঝে না বোঝার ভান করেন? তারা ধর্মের বিপরীতে অধর্মকে সমর্থন করে কি মনে করেন ধর্ম করছেন? আমাদের পুরনো কিছু পুস্তিকা থেকে প্রকৃত ইসলাম ও জামায়াতী ইসলামের পার্থক্য তুলে ধরছি (বন্ধনীতে যেসব বইয়ের নাম উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোর রচয়িতা মওদুদী)
* ইসলাম বলেছে, আল্লাহতায়ালা নির্যাতনমূলক কোন বিধান দেননি। জামায়াতীরা বলেছে, ব্যভিচারের শাস্তি রজম বা পাথর মারা, যা কি না নিঃসন্দেহে নির্যাতন। (তাফহিমাত, ২য় খ-, ২৮১ পৃষ্ঠা)
* ইসলাম বলেছে, ফেরেশতারা নূরের তৈরি আল্লাহর মখলুক। জামায়াতীরা বলেছে, ফেরেশতা প্রায় একই বস্তু যাকে ভারত, গ্রিক প্রতৃতি দেশের পৌত্তলিকরা দেবদেবী স্থির করেছে। (তাজদীদ ও এহইয়ায়ে দ্বীন, ১০ পৃষ্ঠা)
* ইসলাম বলেছে, নবী-রাসূলগণ নিষ্পাপ। তাঁরা কোন গুনাহ করেননি। জামায়াতীরা বলেছে, নবী রাসূলগণ নিষ্পাপ নন। প্রত্যেক নবীই গুনাহ করেছেন (তাফহিমাত, ২য় খ-, ৪৩ পৃষ্ঠা)
* জামায়াতীরা বলেছে, হযরত ইউনুস (আ) নবুয়াতের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেননি। (তাফহিমুল কোরান, ২য় খ-, ৯৯ পৃষ্ঠা)
* হযরত ইব্রাহিম (আ) ক্ষণিকের জন্য শিরক গুনাহে নিমজ্জিত ছিলেন। (তাফহিমুল কোরান, ১ম খ-, ৫৫ পৃষ্ঠা)।
* ইসলাম বলেছে, মহানবী (সা) মানবিক দুর্বলতামুক্ত ছিলেন। জামায়াতীরা বলেছে, মহানবী (সা) মানবিক দুর্বলতামুক্ত ছিলেন না। (তরজমানুল কোরান, ৮৫শ সংখ্যা, ২৩০ পৃষ্ঠা)।
* ইসলাম বলেছে, মহানবী (স) মনগড়া কোন কথা বলেননি। জামায়াতীরা বলেছে, মহানবী (স) মনগড়া কথা বলেছেন। নিজের কথায় তিনি নিজেই সন্দেহ করেছেন। (তরজমানুল কোরান, রবিউল আউয়াল, ১৩৫৬ হিজরী)
* ইসলাম বলেছে, সাহাবা কেরাম অনুসরণযোগ্য। জামায়াতীরা বলেছে, সাহাবাদের অনুসরণ করবে না। (দস্তরে জামায়াতে ইসলামী ৭ পৃষ্ঠা)
* জামায়াতীদের মতে হযরত আবুবকর (রা) দুর্বলমনা ও খেলাফতের দায়িত্ব বহনে অযোগ্য ছিলেন। (তাজদীদ ও এহইয়ায়ে দ্বীন, ২২ পৃষ্ঠা)।
* হযরত আলী (রা) খেলাফত আমলে এরূপ কিছু কাজ করেছেন, যা অন্যায় বলা ছাড়া উপায় নেই (খেলাফত ও মুলকিয়াত, ১৭৩ পৃষ্ঠা)।
* ইসলাম বলেছে, পবিত্র কোরানের মনগড়া ব্যাখ্যা করা হারাম। জামায়াতীরা বলেছে, কোরান মজিদের মনগড়া ব্যাখ্যা করা জায়েজ। (তরজমানুল কোরান, জমাদিউস সানি, ১৩৫৫ হি.)
* ইসলাম বলেছে, রোজাদারের জন্য সুবহে সাদেকের পর পানাহার করা নাজায়েজ। কেউ করলে রোজা হবে না। জামায়াতীরা বলেছে, রোজাদারের জন্য সুবহে সাদেকের পর আজান শুনলেও পানাহার করা বিলকুল জায়েজ। (তাফহিমুল কোরান, ১ম খ-, ১৪৬ পৃষ্ঠা)।
পবিত্র কোরান ও হাদিসের খেলাফ ও ধরনের আরও বহু কথা জামায়াতীরা তাদের বিভিন্ন পুস্তকে বলেছে। সুতরাং পবিত্র ইসলামের মুখোশধারী এই বাতিল ফেরকা থেকে নিজেকে এবং সন্তান-সন্ততিকে দূরে রাখুন। আল্লাহর ইবাদতের স্থান মসজিদকে জামায়াতীদের রাজনৈতিক আখড়ায় পরিণত করতে বারণ করুন এবং এই দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণার জন্য সরকারের কাছে দাবি তুলুন।
বিএনপিও এখন এই অধর্মকে সমর্থন করছে। সুতরাং ধর্মের কারণেও বিএনপিকে প্রতিরোধ করা বাঞ্ছনীয়। তবে সরকার বা ১৪ দলের ওপর নির্ভর করবেন না। যদি ধর্মে আস্থা থাকে এবং মনে করেন জামায়াত-বিএনপি অশুভ শক্তি এবং নিরপেক্ষরা এদের সহায়ক, তাহলে এই উদাহরণগুলো আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ছড়িয়ে দিন। দেশকে পঞ্চদশ শতক থেকে একুশ শতকে আনার চেষ্টায় শরিক হন। সেটিও পুণ্যের কাজ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন