শনিবার, ১৬ মার্চ, ২০১৩

আজব আজব গুজবগুলো

মোস্তফা হোসেইন
বর্ষার রেশ কাটেনি তখনো। খালের পানি তলায় পৌঁছাতেও কিছু বাকি। এর মধ্যে শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের। ১৯৬৫ সালের ঘটনা। গ্রামে রটে গেল, কোনো এক মহাপুরুষ স্বপ্নে দেখেছেন, পাকিস্তানের শত্রুদের রোখার জন্য একটি পাহাড়ই যথেষ্ট। দেশপ্রেমিক মানুষের কাছে এটা কোনো ব্যাপার নয়। এক গ্রাম দুই গ্রাম এমনি করে কয়েক ইউনিয়নের মানুষ এক হয়ে যায়। কাকডাকা ভোরে টুকরি-কোদাল নিয়ে রওনা হয় পূর্বে ভারতীয় সীমান্তে। শত শত মানুষ এক সময় হাজার হাজার হয়ে যায়। ভারতীয় পাহাড়ের পশ্চিমে তৎকালীন পাকিস্তানের সীমান্তে তৈরি হতে থাকে পাহাড়। আধা কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ছোটখাটো একটি টিলা বানানো হয়ে যায় কুমিল্লা জেলার শালদা নদী সীমান্তে।

এখনো যদি কেউ ওই কৃত্রিম পাহাড়ঘেঁষা গ্রামবাসীদের জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা, ওই স্বপ্নদ্রষ্টার নাম কী কিংবা কোথায় তার ঠিকানা? আর পূর্ব সীমান্তে মাইলের পর মাইল বিস্তৃত ভারতীয় পাহাড়ের বিপরীতে আধা কিলোমিটার ছোট একটি টিলায় চড়ে যুদ্ধ করে ওদের রোখা কি সম্ভব হতো? আমি নিশ্চিত, এ প্রশ্নের জবাব কেউ দিতে পারবে না। কিন্তু সত্য হচ্ছে, হাজার হাজার মানুষ কয়েক দিনেই সেখানে একটি টিলা তৈরি করে ফেলতে সক্ষম হয়েছে।

হাওয়া থেকে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে করা এই কাজে মানুষের বড় কোনো ক্ষতি হয়নি। কিন্তু স্বপ্ন কিংবা অলৌকিক কথার রেশ ধরে কখনো কখনো এমন ঘটনাও ঘটে যায়, যার পরিণতি হয় মারাত্মক। মানুষের মধ্যে শুধু বিভ্রান্তিই নয়, মানুষকে দুর্ভোগেও ফেলে বড় আকারের।

চিলের সঙ্গে উড়াল দিতে না পারলেও চিলের পেছনে দৌড়ানোর লোকের অভাব নেই। উড়ন্ত চিলের আবার দেশ-কাল নেই। দুনিয়ার এ-মাথা থেকে ও-মাথা, সবখানেই ঘরসংসার পাততে পারে। আর সেই চিলে কান নিয়ে যাওয়ার বারতাটাও ঠিক ঠিক পৌঁছে যায় এখান থেকে ওখানে, দেশ ছাড়িয়ে, সীমানা ছাড়িয়ে। চিলে কান নিয়ে যাওয়ার গল্প এর পরও পুরনো হয় না। শিক্ষা-সভ্যতা-আধুনিকতাও তাকে হার মানাতে পারে না।

এক সময় প্রপাগান্ডা শব্দটির পেছনে ছিল একটি ধর্মীয় কাজের সূত্র। ১৬২২ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু পোপ দুনিয়ার মানুষকে ধর্মে আহ্বান জানানোর জন্য মিশনারিদের মাধ্যমে যে প্রচার চালাতেন, তাকেই বলা হতো প্রপাগান্ডা। সেই প্রপাগান্ডাই এক সময় অহিতকর এবং স্বার্থসিদ্ধির কাজে ব্যবহার হতে থাকল, যাতে সততা আর সদিচ্ছার রেশটিও রইল না। সে কারণে এখন প্রপাগান্ডা, রটনা, কুৎসা আর গুজব একাকার হয়ে গেছে।

রটনাকারী কিংবা গুজব প্রচারকারীদের কৌশল, বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতাগুণে সহজেই মানুষ তা বিশ্বাস করে। আর সেই মতে তার বাস্তবায়নও করে। সেটা কখনো ব্যক্তিপর্যায়ে থাকে, কখনো আবার সম্প্রদায় কিংবা আঞ্চলিক প্রভাবও বিস্তার করতে সক্ষম হয়। প্রতিপক্ষ কিংবা শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য, প্রতিপক্ষকে মনস্তাত্তি্বকভাবে দুর্বল করার জন্য এই অস্ত্র ব্যবহার হয় যুদ্ধেও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে দেখা গেছে, হিটলার প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে দুর্বল করার জন্য, নিজ বাহিনীকে চাঙ্গা করার জন্য এমন সব প্রচারণার কৌশল গ্রহণ করতেন, যা পরবর্তীকালে সব শ্রেণীর মানুষকে অবাক করে দিতে সক্ষম হয়েছে। অবশ্য এরও অনেক অনেক আগে চেঙ্গিস খানও অশ্বারোহী সৈন্যসংখ্যা নিয়ে প্রচারণার কৌশল অবলম্বন করতেন বলে ইতিহাসে পাওয়া যায়। ফলে যুদ্ধকৌশল হিসেবে এই গুজবের ব্যবহার বহু পুরনো, এটা বলা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে গোয়েবলস এই প্রচারণাকে নেতিবাচক কাজে ব্যবহার করে প্রপাগান্ডা শব্দটিকে গুজবে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন। মিথ্যাকে সত্যে প্রমাণিত করার জন্য প্রচারের এই কৌশল মানুষের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার নতুন মাত্রা দেওয়ার পথিকৃৎ হিসেবে তাই গোয়েবলসকে মেনে নেওয়া হয় সর্বত্র।

শত্রুপক্ষকে মনস্তাত্তি্বকভাবে দুর্বল করার জন্য কোনো কোনো কৌশল আবার মিথ্যাক্রান্ত নাও থাকতে পারে। যেমন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা দেখেছি, হয়তো ১০-১২ জন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা শত্রুবাহিনীকে আক্রমণ করেছে, কিন্তু তাদের সঙ্গে হাজার হাজার গ্রামবাসী যোগ দিয়েছে। থালা-বাটি-ঘণ্টা বাজিয়ে আর জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে পাকিস্তানি শত্রুদের মানসিকভাবে আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে। সেখানে জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে যদি কিছু অতিরঞ্জিত বিষয়ও প্রচারসুবিধা পায়, তাকেও ক্ষতিকর বলে মনে করার সুযোগ নেই। যেমন, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত চরমপত্র নামের ব্যঙ্গাত্মক অনুষ্ঠানে যেসব তথ্য প্রচার হতো, তা অনেক সময়ই ছিল কল্পিত। কিন্তু মনস্তাত্তি্বক যুদ্ধ হিসেবে এই চরমপত্র আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। সেখানে একদিকে চিহ্নিত শত্রুবাহিনী ছিল, আর অন্যদিকে মুক্তিবাহিনী এবং দেশবাসী ছিল একাট্টা। তাই শত্রু-মিত্র সবই ছিল প্রচার-আয়ত্তের মধ্যে।

কিন্তু হালের কিছু গুজব আমাদের অতীতের ভাবনাকে ম্লান করে দেয়। প্রশ্ন জাগে, গোয়েবলসের কি পুনর্জন্ম হয়েছে? আর সেই হিটলারের সহযোদ্ধারা কি এই বাংলায় এসে মাইক হাতে, টেলিফোন ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিজেদের কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে? আমরা দেখলাম, গত সপ্তাহে সারা দেশে প্রচার হয়ে গেল পোলিও টিকা ও ভিটামিন 'এ' ক্যাপসুল খাওয়ানোর কারণে অনেক শিশু মারা গেছে। অসুস্থ হয়ে পড়েছে অনেকে। এমন সংবাদ শোনার পর মা-বাবারা দৌড়ে যেতে থাকেন কাছাকাছি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। যে শিশুটি হয়তো ঘুম থেকে চিৎকার করে জেগে উঠেছে, স্বাভাবিক কারণে সেই শিশুটিকে নিয়েও গভীর রাতে হাসপাতালে দৌড়েছেন উদ্বিগ্ন মা। কোথাও কোথাও ক্ষোভ প্রকাশও হতে থাকে। অথচ ভিটামিন 'এ' খাওয়ালে কারো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াই হওয়ার কথা নয়। হয়ওনি। প্রমাণ পাওয়া গেছে, ভিটামিন 'এ' খাওয়ানোর পর সারা দেশে হাজার হাজার শিশুকে হাসপাতালে নেওয়ার পরও তাদের কারো কোনো অসুবিধা না হওয়া থেকে। এখানে প্রচারকারীরা স্পষ্টত প্রতিপক্ষ হিসেবে ব্যবহার করেছে সাধারণ মানুষকে। আর এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়কে তারা গ্রহণ করেছে, যা মানুষের মধ্যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে সক্ষম। কিন্তু ভাগ্য ভালো, প্রশাসনের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের কারণে বিষয়টি দ্রুত ধ্বংসাত্মক কোনো ঘটনার জন্ম দিতে পারেনি।

একইভাবে আমরা দেখলাম, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসির আদেশ দেওয়ার পর বগুড়ায় এক রাতে রটিয়ে দেওয়া হলো, সাঈদীর ছবি চাঁদে দেখা গেছে। ধর্মভীরু মানুষ সেই প্রচারকে বিশ্বাস করে রাস্তায় নেমে যায়। ধর্মভীরু মানুষগুলোর সঙ্গে মিশে যায় প্রতিক্রিয়াশীল চক্র। তারা প্রতিপক্ষ হিসেবে বেছে নেয় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে। আগুন জ্বালিয়ে, হত্যা করে জঘন্য পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তারা।

আমরা এ দুটি ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাব, চেঙ্গিস খান কিংবা হিটলারের কৌশলকেই দুর্বৃত্তরা বেছে নিয়েছে। একাত্তরে যেমন তারা ধর্মের আবরণে অপরাধগুলো করেছে, এবারও একই কায়দা অবলম্বন করেছে। বগুড়ায় সাঈদীর অলৌকিকত্বের গুজব সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করেছে। সাঈদী কিংবা ভিটামিন 'এ' খাওয়ানোর ব্যাপারে গুজব ছড়ানোর সময় তারা কোথাও মসজিদের মাইক ব্যবহার করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি মোবাইল ইন্টারনেটের মতো আধুনিক প্রযুক্তিও ব্যবহৃত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে বসে থেকেও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এই চক্রের সদস্যরা প্রচার করেছে শিশুমৃত্যুর কল্পিত সংবাদ।

গত মাসে তারা মানিকগঞ্জে কয়েকটি মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা করেছিল, সরকার দেশ থেকে মাদ্রাসা শিক্ষা বাতিল করে দিতে যাচ্ছে। আর এর পরিণতিতে সেখানে কয়েকজন মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটেছে।

গোয়েবলস পত্রিকা, পোস্টার, কার্টুন ইত্যাদির ব্যবহার করেছে। এখন প্রচারের সুযোগ আরো বেড়েছে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, গোয়েবলসের কূটকৌশল অচিরেই মানুষের চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তানি রেডিওতে প্রচারিত মিথ্যাচার, তেমনি বাঙালির চোখে অসত্য বলেই প্রমাণিত হয়েছে। আর সাঈদীর ছবি চাঁদে দেখা কিংবা ভিটামিন 'এ' খাওয়ানোর কারণে শিশুমৃত্যুর তথ্যও মিথ্যাচার হিসেবে প্রমাণ হয়ে গেছে। এসবের ফলে সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়ে সাময়িক যা ক্ষতি হওয়ার তা তো হয়েই গেছে।

কঙ্বাজারের মসজিদের মাইক ব্যবহারকারী সেই গোয়েবলসকে গ্রেপ্তার করার খবর পাওয়া গেছে। তার সহযোগীদের এখনো ধরা সম্ভব হয়নি। কিন্তু রোহিঙ্গা জঙ্গি গোষ্ঠীর যে খবর পাওয়া গেছে, তাদের বিষয়টি সরকারকে ভেবে দেখতে হবে। সব গোয়েবলসকে দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে এর চেয়েও বড় কোনো অঘটন ঘটে যেতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন